আধুনিক কক্সবাজার জেলার জনক ‘ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স’ এর অজানা কাহিনী

জালাল আহমেদ :

হিরাম কক্স—যে নাম অমর হয়ে আছে একটি বাজারের সঙ্গে যোগ হয়ে, কক্সবাজার। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটক আকর্ষক জেলা সদর কক্সবাজার। প্রতি বছর লাখ লাখ ভ্রামণিক কক্সবাজার-টেকনাফ ভ্রমণ করে। হিরাম সাহেবের নাম মনে না থাকলেও কক্স সাহেবের বাজারে সবাই আমরা বছরান্তে একবার যেতে চেষ্টা করি। এখন আমরা উড়োজাহাজে বা বিলাসবহুল নৈশ কোচে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে খুব সহজেই কক্সবাজারে পৌঁছাতে পারি। এমনকি একসময় দোহাজারী পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে হাতির পিঠে বা হেঁটে বা অন্য কোনো বাহনে কক্সবাজার যাওয়া যেত। কিন্তু পঞ্চাশের দশক পর্যন্তও কক্সবাজার যাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা, সাম্পান বা স্টিমার।

সেই কক্সবাজারে হিরাম কক্স কাজ করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে, ১৭৯৯ সালে ম্যালেরিয়ায় তার মৃত্যু পর্যন্ত। হিরাম কক্স (১৭৬০-১৭৯৯) ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা, ক্যাপ্টেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন কূটনীতিক, বার্মায় তিনি কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন ১৭৯৬-৯৭ সময়ে। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে ১৭৯৮-৯৯ সালে আরাকান শরণার্থী ও পুনর্বাসনকাজে নিয়োজিত থাকার সময় তার সদরকে কেন্দ্র করে লোকজনের জন্য একটি বাজার বসে, কালক্রমে যা তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কক্সবাজার নামে খ্যাতি লাভ করে। আর এর পুরনো নাম পালংকি স্মৃতি থেকে কালক্রমে মুছে যায়।

চট্টগ্রাম, তার দক্ষিণ সীমান্ত সবসময়ই একটি অস্থির অঞ্চল। দীর্ঘদিন ধরেই নাফ নদী একটি স্বাভাবিক সীমান্তরেখা। কিন্তু এ লক্ষ্মণরেখা ডিঙিয়ে আরাকানরাজ অনেকবারই চট্টগ্রাম পর্যন্ত দখল করেছে। আবার ত্রিপুরার মানিক্য রাজেরা তাদের বিতাড়িত করেছে। ১৬৫৮ সালে সম্রাট শাহজাহানের পুত্ররা উত্তরাধিকারের সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং তত্কালীন বাংলার ২২ বছর শাসনকারী সুবাদার শাহ সুজাসহ তিন ভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে পরাজিত হয়। সুজা ১৬৬০ সালে থাট্টা থেকে পালিয়ে ঢাকা আসেন। সেখান থেকে জাহাজে ভুলুয়া (বর্তমান নোয়াখালী) হয়ে দেয়াং (কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে) পৌঁছান। চট্টগ্রাম থেকে আরাকান হয়ে জাহাজে মক্কা যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্থলপথে হাজারো পালকির বহর নিয়ে আরাকানের দিকে রওয়না হন। পথিমধ্যে হাজার ডুলি (পালকি) যেখানে বিশ্রামের জন্য নামানো হয়, তার নাম হয় ডুলাহাজরা। ঈদের দিন হলে পথেই ঈদ জামাত আদায় করা হয় ‘ঈদগাহ’-এ।

আর পালকি নামিয়ে অপেক্ষার সময় যেখানে কাটানো হয়, সে স্থানের নাম হয় পালংকি (কক্সবাজারের পুরনো নাম)। জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট এবং উইকি উভয়ই এ কথা উল্লেখ করেছে। কে যে কাকে অনুসরণ করেছেন কে জানে। আরাকানের ম্রাউক ইউ (ম্রোহং) বংশীয় রাজা চন্দ্র সুধর্ম্যা বা সান্দা-থু-ধাম্মা (১৬৫২-১৬৮৪) শাহ সুজাকে আশ্রয় ও মক্কা পাঠানোর আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করেননি। সে ভিন্ন ইতিহাস। শাহ সুজাকে অনুসরণ করে মোগল ফৌজ চট্টগ্রামে চলে আসে। ১৬৬৬ সালে মোগল বিজয়ের পর চট্টগ্রামে একটা স্থিতাবস্থা আসে, কিন্তু আরো দক্ষিণে নাফ নদীর এপার-ওপারে একটা অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করতেই থাকে। ১৭৫৬ সালে নাফ নদী পর্যন্ত এলাকা মোগল অধিকারে আসে।

তখন বার্মা বা মিয়ানমার পরিচিত ছিল ‘আভা সাম্রাজ্য’ হিসেবে। ইনওয়া বা আভা ছিল চতুর্দশ শতকে স্থাপিত আভা সাম্রাজ্যের রাজধানী। চতুর্দশ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এ রাজবংশ বার্মার শাসন পরিচালনা করে। এর মাঝে রাজধানী শহর একাধিকবার পরিবর্তন হলেও তা আভা নামেই পরিচিত ছিল। ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত এ বিশাল রাজ্য শত্রু বা বন্ধু যা-ই হোক, নজরে রাখা প্রয়োজন। এ কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভালোই বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা আভায় একজন প্রতিনিধি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধ্যাদেশ জারি হয়। পরবর্তী সময়ে ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োজিত হন। ওয়ারেন হেস্টিংস প্রতিবেশীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আগ্রহী ছিলেন এবং তার সময়েই ১৭৭৪ সালে প্রথম ভুটান হয়ে তিব্বতে দূত প্রেরিত হয়। আভা তথা মিয়ানমারে এর ধারাবাহিকতায় দূত প্রেরণ করা হয়। ১৭৮৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালের শেষ ভাগে এসে আরাকান রাজের পতন হয়।

আভার রাজা বোধপায়া (১৭৮২-১৮১৯) আরাকান সীমান্তে সবসময়ই একটি শত্রুভাবাপন্ন অবস্থা তৈরি করে রাখেন। ১৭৮৪ সালে আরাকানের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগে একজন রাজ অমাত্য (আরাকানি মীরজাফর) কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে এসে ম্রাউক ইউ রাজবংশের পতন ঘটান। এর মাধ্যমে আভা চলে আসে চট্টগ্রাম তথা কোম্পানির সীমান্তে আর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, বাস্তুচ্যুত আরাকানিরা সীমান্ত পার হয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমান্তে আশ্রয় নিতে থাকে। শাসক পরিবার, অমাত্য ও ছোট ছোট জমিদারও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে কোম্পানির এলাকায় প্রবেশ করে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত এসএনএইচ রিজভি সম্পাদিত চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে যে ‘they were allowed to settle on the extensive tracts of waste land then untenanted. Many of these fugitives became peaceable cultivators.’ কোম্পানির পক্ষে চট্টগ্রামের শাসক তাদের বসতি স্থাপন ও চাষাবাদের জন্য জমি বন্দোবস্ত দিতে থাকেন।

চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডস (১৭৬০-১৭৮৭)-এ উল্লিখিত মুক্তারাম গোমস্তার আরজিতে উল্লিখিত, ‘on the 22nd Jheyt in the evening Waza, the Pegu Raja arrived at Bara Palang with 3000 men armed with muskets and immediately seized my Talookdars and Ryots to the number of 120 and confined them during then. In the meantime the rest of my people made their escape to Rumoo.’ এখানে ‘বারো পালং’ শব্দদ্বয় লক্ষণীয়। এ প্রতিবেদন দেয়া হয় ঘটনার তিনদিন পর ৫ জুন ১৭৮৭। ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডস অনুযায়ী ১৬ জুন ১৭৮৭ সম্রাট বোধপায়া নিয়োজিত আরাকানের সাত সর্দারের একজন ‘মেনভেইন্স সাকানুরা’ চট্টগ্রামের শাসককে এসব বিষয়ে এক পত্র দেন।

একই তারিখে আরেক পত্রে উল্লেখ আছে, ‘from the Raja of Arakan to the Chief of Chittagong. Our territories are composed of 560 countries and we have ever been on terms of friendship and the inhabitants of other countries willingly and freely trade with countries belonging to each of us.’ এরপর আরাকানের রাজা একাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদের ফেরত চান। জেলা গেজেটিয়ারে আরো আছে, ১৭৯৩ সালে আরাকান প্রতিরোধ আন্দোলনের তিনজন নেতা কোম্পানির এলাকায় অর্থাৎ সীমান্ত পার হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। পাঁচ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নাফ নদী পার হয়ে কক্সবাজারে ঢুকে পড়ে। পলাতকেরা অপরাধী হলে ফেরত দেয়া হবে, এ আশ্বাসে এ বাহিনীকে ফেরত পাঠানো যায়।

ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের পুত্র হেনরি সিএম কক্স ১৮২১ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব আ রেসিডেন্স ইন দ্য বার্মান এম্পায়ার অ্যান্ড মোর পারটিকুলারলি অ্যাট দ্য কোর্ট অব অমরাপুর’ বাই ক্যাপ্ট. হিরাম কক্স, অব দ্য অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিজ বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির মুখবন্ধে উল্লেখ করেন, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে আভায় কোম্পানির প্রতিনিধি বা দূত ছিলেন ক্যাপ্টেন সাইমস। তিনি দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে আসেন। তখন ভারতে কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ছিলেন স্যার জন শোর (১৭৯৩-৯৮)। তিনি তখন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে ক্যাপ্টেন সাইমসের স্থলে বার্মায় নিয়োগ প্রদান করেন, কিন্তু একটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে।

উদ্দেশ্যের ভিন্নতা বোঝা যায়, ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে আভায় না পাঠিয়ে ইরাবতীর মোহনায় অবস্থিত রেঙ্গুনে প্রেরণ করেন। স্মর্তব্য, ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ বাহিনী রেঙ্গুন হয়েই ইরাবতী বেয়ে গিয়ে মান্দালয় আক্রমণ করে বার্মার রাজবংশের পতন ঘটায়। ফলে হিরাম কক্সের নিয়োগের পেছনে বাণিজ্যের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরিও একটি উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়। ফলে উভয় দেশের সীমান্তের এক উত্তপ্ত অবস্থায় ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তার কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য রেঙ্গুন গমন করেন।

তিনি তার জার্নালের শুরুতেই ৮ অক্টোবর ১৭৯৬ তারিখে উল্লেখ করেন, ‘I shall commence my detail with the arrival of the Swallow packet in the Rangoon river, where I was met by a boat containing the king’s linguist, who brought me a present of fruit from Shabunder of Rangoon, and informed me, that the Nakhan and a Sercedoghee were in waiting at the entrance of the river, to compliment me on my arrival.’ তার মানে তাকে ইরাবতী নদীর মোহনায় বন্দর কর্তার পক্ষে রাজার একজন দোভাষী ফলের ঝুড়িসহ আপ্যায়ন করে। তার জার্নালের সবশেষ ভুক্তি ১ নভেম্বর ১৭৯৭ তারিখের, যখন তিনি রাজধানী অমরাপুর সফর করে ১১ মাস পর ফিরে আসেন।

তিনি লিখেন, ‘At seven A.M. we arrived at the pier at Rangoon, and found an English snow, the Peggy, Captain Carey of Bengal. The Shabunder Jhansey came on board with Mr. Dyer. After breakfast I landed , and went up to my house;in the course of the day most of my baggage was landed. And thus ends my expedition to Amarapoorah, on which I have been absent from Rangoon eleven months wanting four days.’

হিরাম কক্স যখন রেঙ্গুন ও অমরাপুরে তার দায়িত্ব পালন করছেন তখনো আরাকান থেকে রিফিউজি আগমন থেমে থাকেনি। আর চট্টগ্রাম জেলা শাসকের জন্যও এটি ছিল একটি বাড়তি বোঝা ও ঝামেলা। চট্টগ্রাম জেলা গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে ‘From this period (1793) commenced an incessant immigration of Maghs from Arakanin to the district, which was also selected ads an asylum by all the adjacent insurgent chiefs. Between the year 1797 and 1800, it is said that about thirty or forty thousand persons emigrated from Arakan into the Chittagong district; and by 1798, so large a body of emigrants arrived that the comprehensive measures had to be adopted by Government for their support.’ এদিকে হিরাম কক্স ততদিনে রেঙ্গুনে দায়িত্ব পালন শেষে কলকাতায় ফিরে এসেছেন।

গভর্নর জেনারেল জন শোর ফিরে গিয়েছেন আর মারকুয়েস ওয়েলেসলি তখন গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বে। হেনরি কক্স তার পিতার জার্নালের মুখবন্ধে লিখছেন, ‘The tyranny of the Burmhan government in the province of Arracan, drove a very considerable body of its unfortunate inhabitants to the dire resolution of abandoning their homes and native country, to seek a precarious existence in the woods and forests, which form the boundary of our territories on the Chittagong frontier. To give immediate assistance to these unfortunate beings. Captain Cox was commissioned to proceed to Chittagong, for the purpose of arranging the most effectual means of relieving their necessities, by giving them a permanent settlement on waste lands of that extensive district.’ উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জন্ম হয় তারও ৬২ বছর পর ১৮৬০ সালে।

সমসাময়িককালে তিন মাস ধরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা সফর করেন ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন, যিনি তার এ ভ্রমণ বিবরণী ‘an account of a journey through the provinces of Chittagong and Tiperrah.’ রেখে যান। দক্ষিণ ভারত, বিহার, নেপাল, বার্মা সম্পর্কে বুকাননের ভ্রমণ বিবরণী দীর্ঘদিন আগে প্রকাশিত হলেও লোকচক্ষুর আড়ালে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে থাকা এ ভ্রমণ বিবরণী প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ডাক্তার ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন ১৭৯৮ সালের মার্চ-এপ্রিলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তার এ ভ্রমণ করেন। এ সময়ের পুরো বিবরণীতেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আরাকান থেকে আসা শরণার্থীদের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তাদের কেউ কেউ পুনর্বাসিত, কেউ জমি বন্দোবস্ত পেয়ে চাষবাস করছেন আর কেউ কেউ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন।

যেমন ৩ এপ্রিল ১৭৯৮ বুকানন লেখেন, ‘Today in spite of all my endeavors, I could effect only my passage across the mouth of the Ramoo river,…….The bengalese of this village are chiefly Mussalmans, and cultivate the ground in a fine valley, watered by Ramoo river. It is said that in the whole of this valley there are fifteen thousands Rakain, who have fled hither since the conquest of their country.’ তবে যে বিষয় আমার কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে তা হলো ‘বারো-পালং’-এর কথা। আমরা কক্সবাজারের পূর্ব নাম পালংকি বলছি। আর পালং নাম কক্সবাজার জেলায় এখনো প্রচলিত ও পরিচিত। ডাক্তার বুকানন যখন ১৭৯৮ সালে কক্সবাজার অঞ্চল ভ্রমণ করেন, তখন এ নামে কোনো জায়গা ছিল না।

কিন্তু তিনি অন্তত ১২টি পালংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন এবং পালং বলতে প্রচলিত ছিল ছোট পাহাড় বা পাহাড়যুক্ত এলাকা। তিনি এক্ষেত্রে ১২টি পালংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যার কোনো কোনোটি এখনো একই নামে বিদ্যমান। ডাক্তার বুকানন উল্লেখ করেন ‘Weella (wala), Rutna (Rotna), Rungka (Rumkha), Rutnakaaga, Hulludea (Haladia), Huzzalea (Hazalia), Rajah (Raja), Kootoo, Dua (Dhoa), Detchua (Dechuar), Pagully (paglir), Deelia, and Sunna.’ এসব নামের সঙ্গে পালং যুক্ত এবং এগুলো উখিয়া ও রামু উপজেলায় অবস্থিত। বর্তমান কক্সবাজার শহর এলাকায় যে পালং ছিল তা হয়তো হিরাম কক্সের মৃত্যুর পর তার নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়। অন্য পালংগুলোর অনেক নাম আমরা সাময়িক ভ্রমণকারীরা ঢাকায় বসেও জানি।

ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স দায়িত্বপালনকালে কাজের ধরন, এর সঙ্গে যুক্ত পরিশ্রমে কাবু হন এবং পরবর্তী সময়ে ম্যালেরিয়ায় মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার ছেলে হেনরি কক্স লিখছেন, ‘In an active performance of the arduous duties of this situation, and in a climate peculiarly noxious to an european constitution, Captain Cox persevered till his own life became a sacrifice to his zeal and sense of public duty.’ হেনরি কক্স আরো উল্লেখ করেন, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অকালমৃত্যু হওয়ায় তিনি তার জার্নাল সম্পূর্ণ করতে পারেননি। আমার ধারণা, বার্মায় লেখা জার্নাল কলকাতায় থেকে যায়, যা পরে হেনরির কাছে পৌঁছায়, কিন্তু কক্সবাজার অবস্থানকালের জার্নাল হয়তো মৃত্যুর পরে আর যথাযথভাবে কলকাতায় পৌঁছানো হয়নি। হলে সে সময়ের কক্সবাজারের একটি বাস্তব বিবরণ আমরা পেতাম।

কক্সবাজার ও বার্মার ইতিহাসে হিরাম কক্স
মুহম্মদ নূরুল ইসলাম :: আধুনিক ‘কক্সবাজার’ নামটি যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তিনি হচ্ছেন ‘হিরাম কক্স’। তিনি ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে) স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা মেরি ছিলেন আলেকজান্ডার ফ্রেজারের কন্যা, যার প্রমাতামহ ছিলেন অষ্টম লর্ড লোভেটা। পিতা হেনরি চেম্বাস মারভে কক্স কিউ ভি।

পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তিনি ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আসেন এবং ১৮ সেপ্টেম্বর কমিশন লাভ করেন। কমিশন লাভের পর থার্ড বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের পদাতিক বাহিনীতে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান এবং ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব ঘাড়ের ওপর চাপার পরেই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন।

১১ এপ্রিল, ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। চিন্তাভাবনা না করেই তিনি হুট করে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে যান। এবার বিয়ে করে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করলেন। এর মধ্যে ইংল্যান্ডে পাঁচ-পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেল, ছেলের বাবা হলেন। এবার ইংল্যান্ডের চেনাজানা পরিবেশে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। আবার সাত সাগর, তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এলেন। ফিরে এলেন সেই চিরচেনা পুরনো ডেরায়।

২৯ অক্টোবর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ। আগে ছেড়ে যাওয়া চাকরিতে যোগ দিলেন। পুনরায় থার্ড বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করলেন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাকে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দিল এবং ব্যাটালিয়ন ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করল। কিন্তু এই পদে তার বেশি দিন থাকা হলো না।

তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাকে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাকে বার্মায় কোম্পানির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে। পূর্ববর্তী ক্যাপ্টেন সাইমস মিশনের সাফল্য সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং বার্মা সরকারের সঙ্গে কোম্পানির সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত করার জন্যই ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নেতৃত্বে বার্মায় পরবর্তী মিশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে বার্মায় ক্যাপ্টেন কক্সের নিয়োগ ছিল কোম্পানির একজন রেসিডেন্টের, রাষ্ট্রদূতের পদে নয়। মিশনটির উদ্দেশ্য ছিল মূলত তিনটি। প্রথমত, বার্মা ও বাংলার মধ্যে বিদ্যমান সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি সাধন করা। দ্বিতীয়ত, বার্মায় বাণিজ্যরত ব্রিটিশ নাগরিকদের স্বার্থ ও সুবিধার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা। সবশেষে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে বার্মায় ফরাসি প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা। এছাড়া বার্মা সম্পর্কে ক্যাপ্টেন সাইমস কর্তৃক সংকলিত বিবরণের অবশিষ্টাংশ প্রণয়নের দায়িত্বও ক্যাপ্টেন কক্সকে দেয়া হয়।

এ পর্যায়ে বার্মার অভ্যন্তরীণ শাসন, শিল্পকলা, বাণিজ্য, সাহিত্য ও ভৌগোলিক বিষয়গুলো অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। উদ্দেশ্যটি স্পষ্টতই ব্রিটিশদের সামরিক তৎপরতার অগ্রবর্তী গুপ্তচরবৃত্তির অংশ ছিল। কলকাতায় একজন বর্মি রাষ্ট্রদূত প্রেরণের জন্য বর্মিরাজকে উত্সাহী করে তোলার নির্দেশও ক্যাপ্টেন কক্সকে দেয়া হয়। বাণিজ্য প্রসঙ্গে রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে তাকে কয়েকটি বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে ক্যাপ্টেন সাইমস বার্মায় কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। তার কারণেই বার্মার সঙ্গে কোম্পানির মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাইমস কলকাতা ফিরে গভর্নর জেনারেলের কাছে ঠিক উল্টো বিবরণ প্রদান করেন। এতে গভর্নর জেনারেল তথা কোম্পানি প্রকৃত অবস্থা থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল। ঠিক সেই নাজুক সময়ে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে বার্মায় কোম্পানির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

একজন দোভাষী, কয়েকজন কেরানি ও ভৃত্য, একজন হাবিলদার ও নায়েকসহ ১২ জন সিপাহির একটি ক্ষুদ্র দেহরক্ষী দল নিয়ে ক্যাপ্টেন সিম্পসন পরিচালিত কোম্পানির জাহাজ ‘সোয়ালো’র মাধ্যমে ক্যাপ্টেন কক্স ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর রেঙ্গুন পৌঁছান। রেঙ্গুন পৌঁছে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করে কোম্পানির প্রাক্তন প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন সাইমসের স্থলাভিষিক্ত হন।

প্রকৃতপক্ষে ক্যাপ্টেন কক্সের রেঙ্গুন বন্দরের সহকারী কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই একটি ঘটনা কোম্পানির মিশনের প্রতি বর্মিদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায়। ঘটনাটি ছিল বর্মি রাজা কর্তৃক কোম্পানির কাছে আরাকানে অরাজকতার অপরাধে অভিযুক্ত কয়েকজন সর্দার ও তাদের পরিবারবর্গের প্রত্যর্পণ দাবি। উল্লেখ্য যে সর্দারদের প্রত্যর্পণ দাবি ছিল ক্যাপ্টেন সাইমসের কাছে বর্মিরাজের চিঠিতে উল্লে-খিত বক্তব্যেরই প্রতিফলন। ভারতের গভর্নর জেনারেল জন শোর বর্মিরাজের এ দাবি অযৌক্তিক মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশ্য এ বিষয়ে তিনি বর্মিদের সব বক্তব্য বার্মায় কোম্পানির রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন কক্সের কাছে পেশ করার অনুরোধ জানান।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর বার্মা রাজা বোধপায়া স্বাধীন আরাকান আক্রমণ করেন এবং ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে সম্পূর্ণ দখলে নেন। বর্মি রাজার সেনাপতি মহাবান্দুলার নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ফলে প্রায় এক লাখ আরাকানি কক্সবাজারের রামু, ঈদগাঁহ, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে অত্যাচারিত আরাকানিরা প্রাক্তন রাজবংশের ওয়েসো নামে জনৈক বংশধরকে রাজা হিসেবে মনোনীত করে বর্মি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বর্মিরা এই বিদ্রোহ দমন করে। এরপর অত্যাচার আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইরাঙ্কিন বলেন, ‘বর্মিরা বিজিত ও নিরীহদের ওপর অত্যাচারের জন্য দায়ী। আমার আদৌ সন্দেহ নেই যে হাজার হাজার নর-নারী ও শিশুকে সুস্থ মস্তিষ্কে হত্যা করা হয়েছে।’

এ ঘটনার পর আরাকানের আর এক অমাত্যের সন্তান সিনপিয়ান (ব্রিটিশরা তাকে কিং বেরিং নামে ডাকে) আরাকানের হূত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে দেশপ্রেমিক আরাকানিদের সংগঠিত করেন এবং একাধিকবার বর্মি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বর্মি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। এ কারণেই বর্মিরাজ আরাকানি সর্দারকে তাদের হাতে প্রত্যর্পণের দাবি জানান।

ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স দীর্ঘ চার মাস রেঙ্গুনে অনেক দৌড়-ঝাঁপ করে অবশেষে লুট্টর তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী তথা হানসাওয়াদির মিথোউন এবং রেঙ্গুনের ইয়েউনের সাহায্যে ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্মিরাজের সাক্ষাৎ লাভে সক্ষম হন। এই সময় ক্যাপ্টেন কক্স বর্মিরাজের কাছে তিনটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপি তিনটি ছিল কোম্পানির প্রতিনিধির কূটনৈতিক অধিকার, বাণিজ্যিক স্বার্থ ও ফরাসি তৎপরতাসংক্রান্ত। কোম্পানির প্রতিনিধির কূটনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত স্মারকলিপিতে ক্যাপ্টেন কক্স নিম্নোক্ত দাবিগুলো পেশ করেন। প্রথমত, কোম্পানির এজেন্ট বার্মার আইনের এখতিয়ারের বহির্ভূত এবং তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ কলকাতা কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপন করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কোম্পানির এজেন্টকে রেঙ্গুনে অফিস, বাসগৃহ নির্মাণের অধিকার দিতে হবে। এছাড়া এজেন্ট ও তার লোক-লস্করদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ হবে সর্বপ্রকার শুল্কমুক্ত।

তৃতীয়ত, ব্রিটিশ এজেন্ট তার নিরাপত্তার জন্য দেহরক্ষী রাখতে পারেন, তবে দেহরক্ষীর সংখ্যা বর্মি সরকার নির্ধারণ করবেন।

সবশেষে কোম্পানির এজেন্ট বর্মিরাজ ও রাজবংশের সদস্যদের কাছে অবাধ গমনাগমন করতে পারবেন। এছাড়া ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সব যোগাযোগ কোম্পানি এজেন্টের মাধ্যমে করতে হবে।

বাণিজ্যিক স্বার্থসংক্রান্ত স্মারকলিপিতে ক্যাপ্টেন কক্স বর্মিরাজের কাছে যেসব দাবি পেশ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো—১. বাণিজ্যিক উন্নতির জন্য মুদ্রার প্রচলন, ২. রেঙ্গুনের জাহাজের ওপর শুল্ক হ্রাস, ৩. রেঙ্গুনে বন্দরে দ্রব্যাদি পরীক্ষা করার আপত্তিকর পদ্ধতির বিলোপ, ৪. আমদানি শুল্ক হ্রাস করে ৫ শতাংশে স্থিতিশীলকরণ, ৫. বর্মি বণিকদের কাছ থেকে বকেয়া দাবি আদায়ে বর্মি সরকারের আইন ও প্রশাসনিক বিভাগের সাহায্যে, ৬. সমুদ্রের মধ্যে ব্রিটিশ নাগরিকদের জাহাজসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ বর্মি সরকারের বিচারের এখতিয়ারভুক্ত না হওয়া, ৭. উভয় দেশের বণিকদের মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা উভয় পক্ষের প্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পাদন করা, ৮. দ্রবাদি ক্রয় ও বিক্রয়ে ইংরেজ বণিকদের বার্মায় যথেচ্ছ গমনাগমনের সুবিধা, ৯. ব্রিটিশ জাহাজগুলোর যাত্রী ও নাবিকদের জন্য বার্মা থেকে তিন মাসের রসদ সংগ্রহের অনুমতি, ১০. বার্মায় কোনো ব্রিটিশ বণিকের মৃত্যু হলে তার সমুদয় সম্পত্তি কোম্পানির এজেন্টের কাছে হস্তান্তরকরণ এবং ১১. বন্দরে শুল্ক পরিশোধ করার পর কোম্পানির জাহাজ বিলম্ব না করানো।

বর্মিরাজের কাছে উপস্থাপিত ক্যাপ্টেন কক্সের তৃতীয় স্মারকলিপি ছিল বার্মায় ফরাসিদের প্রভাব সম্পর্কে। ক্যাপ্টেন কক্স দাবি করেন যে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি কর্তৃক তিনজন আরাকানি সর্দারকে বর্মিদের হাতে এ শর্তে অর্পণ করা হয়েছিল যে বর্মি সরকার ইংরেজদের শত্রুদের বিশেষত ফরাসিদের বার্মায় আশ্রয় দেবে না এবং ফরাসি জাহাজগুলোকে মেরামত বা লুণ্ঠিত দ্রব্য খালাস করার জন্য বর্মি বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। ওই শর্তানুযায়ী ক্যাপ্টেন কক্স দাবি করেন যে কোনো ফরাসি জাহাজ বর্মি বন্দরে অবতরণ করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বন্দর ত্যাগ করার নির্দেশ দিতে হবে, অন্যথায় জাহাজটি বাজেয়াপ্ত করা হবে। তিনি আরো উল্লে¬খ করেন যে বর্মি কর্মচারী বা প্রজারা ফরাসি জাহাজকে কোনো রসদ বা অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে পারবেন না।

অবশেষে ক্যাপ্টেন কক্সের স্মারকলিপি লুট্টর রাজদরবারে আলোচিত হয়। আলোচনার সময় বর্মি মন্ত্রীরা কিছু অপ্রত্যাশিত সুপারিশ করেন। প্রথমত, চট্টগ্রামে আশ্রিত আরাকানি উদ্বাস্তুদের প্রত্যর্পণের জামিনস্বরূপ রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন কক্সকে বার্মায় আটক রাখা হোক। দ্বিতীয়ত, বাংলার চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ ও ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চল বর্মি সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য কোম্পানির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হোক। উল্লেখ্য যে একত্রে বর্মি মন্ত্রীরা ঐতিহাসিক কারণ দর্শিয়ে এই অঞ্চলসমূহ আরাকানিদের অধিকারভুক্ত বলে গণ্য করেন। অবশ্য পরে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ঢাকার অর্ধেক অংশ দাবি করার বিকল্প সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন কক্স ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তিনি গভর্নর জেনারেলকে জানান, ‘অল্পকালের মধ্যে আমার কোনো চিঠি না পেলে ধরে নেবেন যে আমি অন্তরীণাবদ্ধ ও সকল প্রকার যোগাযোগ বর্জিত।’ ক্যাপ্টেন কক্স এ সময় বর্মিদের সামরিক প্রস্তুতির কথা কোম্পানিকে অবগত করান। তিনি জানান যে বর্মি সরকার আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম ও আসাম সীমান্তে ২০ হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে। এছাড়া ১০ হাজার সৈন্যের একটি দল রেঙ্গুন ও পেগুর নিরাপত্তার জন্য বার্মার দক্ষিণাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে।

এ সময় ক্যাপ্টেন কক্স বার্মা সম্পর্কে ক্যাপ্টেন সাইমস প্রদত্ত বিবরণের তীব্র সমালোচনা করেন। কক্সের মতে বার্মা সম্পর্কে ক্যাপ্টেন সাইমসের অতিরঞ্জিত কাহিনী কোম্পানিকে বর্মিদের প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে এবং পরিণামে এ ব্যবস্থা কোম্পানিকে ভুল পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করেছে। দুটি জনশ্রুতি কোম্পানির প্রতি বর্মি সরকারের বিরূপ মনোভাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ জনশ্রুতি দুটি হলো মিনগুনের প্যাগোডা নির্মাণে বার্মা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী। এ ঘটনার আগে বার্মার ধাতু নির্মিত নতুন মুদ্রা প্রবর্তন করা হবে বলে জনৈক ফুঙ্গি আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। উল্লে¬খ্য, কিছুদিন আগে বর্মিরাজ বোধপায়া ধাতু নির্মিত নতুন মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং ক্যাপ্টেন কক্স তাকে কিছু মুদ্রা ও একটি মুদ্রাযন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। নতুন মুদ্রা প্রচলনের ফলে বার্মার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এ অবস্থাকে নতুন মুদ্রা প্রবর্তনজনিত ফল হিসেবে গ্রহণ না করে শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন কক্সকেই তাদের দুর্গতির জন্য দায়ী করা হয়। এছাড়া আসামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বার্মা ও বাংলার পরস্পরবিরোধী ভূমিকা কোম্পানির প্রতি বর্মিদের বাকি আন্তরিকতাও লুপ্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রাজপ্রাসাদে একটা ঘটনা কক্সকে নতুন করে অনুকূল পরিবেশের প্রত্যাশায় আশান্বিত করে তোলে। ক্যাপ্টেন কক্সের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধাচরণকারী মিইন উনজি বর্মি সভাসদের সহায়তায় বর্মিরাজ বোধপায়াকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করে ব্যর্থ হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন কক্স পুনরায় বর্মিরাজের কাছে তার দাবিগুলো উত্থাপন করেন। কিন্তু তার দাবিগুলো প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তিনি ১৭ অক্টোবর অমরাপুরা ত্যাগ করে নৌকাযোগে ১ নভেম্বর রেঙ্গুন পৌঁছান। রেঙ্গুনেও ক্যাপ্টেন কক্সকে এক বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। হানসাওয়াদির মিয়োউন ক্যাপ্টেন কক্সকে অনতিবিলম্বে অমরাপুরায় প্রত্যাবর্তনের জন্য নির্দেশ জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এ নির্দেশের অর্থ ছিল রেসিডেন্টের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করা।

রেঙ্গুন ও অমরাপুরায় ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্মি সরকার রেঙ্গুনে কোম্পানির রণতরীর আক্রমণের আশঙ্কা করে এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ক্যাপ্টেন কক্স জানান, বিনা অনুমতিতে কোনো জাহাজ রেঙ্গুন নদী বেয়ে যাতে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য রেঙ্গুনের কাছে বর্মি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এ সময় রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন কক্স বার্মার সঙ্গে বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক ও কর্মপন্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি কোম্পানিকে জানান, অতীত অপমানের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ এবং ভবিষ্যৎ আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো শর্তে এদের সঙ্গে আপস করবেন না। এ উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে তরবারি হাতে নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে। আপনাদের পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য এ জাতির সঙ্গে একটি দৃঢ় মৈত্রী চুক্তির জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। এরা যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে না আসে, কিংবা আমরা যদি এদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার অর্জন করতে না পারি তবে শিগগিরই বাংলার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে।

কোম্পানি এ পর্যায়ে মিশনের ব্যর্থতার জন্য রেসিডেন্ট কক্সকেই দায়ী করে এবং রেসিডেন্টকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়। তাকে জানানো হয় যে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনে বর্মিরা কোনো বাধা দিলে কোম্পানির সুপ্রিম কাউন্সিল সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ সময় হঠাৎ করে বর্মিদের মনোভাব পরিবর্তন হয় এবং তারা কোম্পানির মিশনের প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে। সম্ভবত মিশনটি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সংবাদই বর্মিদের মনোভাব পরিবর্তনের কারণ ছিল। ক্যাপ্টেন কক্স ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন কলকাতায় ফিরে আসেন।

ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স কলকাতা ফিরে আসার পরেই তাকে চট্টগ্রামের দক্ষিণে আরাকানি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব দিয়ে হিরাম কক্সকে চট্টগ্রামের কালেক্টর মি. ফ্রায়ারের কাছে পাঠানো হয়। হিরাম কক্সের নিযুক্তির আগে চট্টগ্রামের কালেক্টর তার নিজস্ব লোকজনদের মাধ্যমেই উদ্বাস্তুদের দেখভাল করতেন। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নতুন নিয়োগ পাওয়ার পর চট্টগ্রামের পরির পাহাড়ে পৌঁছে কালেক্টর মি. ফ্রায়ারের কাছে তার পরিচয়পত্র পেশ করেন।

তখন শুষ্ক মৌসুম। সম্ভবত ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর বা ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তার বাহিনী নিয়ে রামু পৌঁছেন। তিনি রামু পৌঁছে আরাকানি উদ্ভাস্তুদের অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং তাদের পুনর্বাসনে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কক্সের স্থান নির্বাচন ছিল সুস্পষ্ট এবং সুদৃঢ়। কোম্পানি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। কক্স সরকারি মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলেই পুনর্বাসনের স্থান নির্ধারণ করেন। দক্ষিণাঞ্চলে এরই মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্বাস্তুরা বসবাস শুরু করে দিয়েছিল। উত্তরাঞ্চলে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করার পক্ষে পূর্বে বোর্ড অব রেভিনিউর সদস্য টমাস গ্রাহাম জোর সুপারিশ রেখেছিলেন।

ক্যাপ্টেন কক্সের দক্ষিণাঞ্চলে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কারণ ছিল এই যে: ১. চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে চাষাবাদ ও বসতি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, ২. উদ্বাস্তুদের বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সমষ্টিগতভাবে পুনর্বাসন দেয়া প্রয়োজন, যেখানে এরা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে এবং নিজেদের প্রাচীন আইনের মাধ্যমে শাসিত হয়ে বনভূমি আবাদ করে উত্পাদন বাড়াতে সক্ষম হবে, ৩. উদ্বাস্তুদের ব্যক্তিগতভাবে পুনর্বাসন সাময়িকভাবে লাভবান করবে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্বাস্তুদের জীবন হবে দরিদ্র ও ভবঘুরের মতো এবং তারা এই নিরাপত্তাহীন জীবন বেশিদিন পছন্দ করবে না। তাই তিনি উদ্বাস্তুদের বাঁকখালী নদী অথবা নাফ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে পুনর্বাসনের স্থান নির্বাচন করেন।

এ অঞ্চলে পুনর্বাসনে তিনি একটি প্রশাসনিক সুবিধাও দেখেন। আর তা এই যে তাদের জঙ্গি স্বভাব মগ, বর্মি বা পার্বত্যবাসীর আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে লাগবে। তবে তিনি কিছু অসুবিধাও লক্ষ করেন। প্রথমত, কোম্পানির প্রতি বর্মি সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং দ্বিতীয়ত, আরাকানি বিদ্রোহী সর্দারদের আক্রমণের প্রবণতা। সমকালীন নথিপত্রে তার প্রমাণ না থাকলেও বার্মা মিশনে কক্সের তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্ভবত তাকে উদ্বাস্তুদের এ অঞ্চলেই পুনর্বাসিত করে বর্মি সরকারের মাথাব্যথার কারণ সৃষ্টি করার কাজে উত্সাহী করে তুলেছে। কক্সের বার্মা মিশনটি ছিল মোটামুটি ব্যর্থ এবং মর্যাদাহানিকর। কখনো কখনো তাকে অদক্ষ অফিসার মনে হতে পারে। কিন্তু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে তার সিদ্ধান্ত ছিল বলিষ্ঠ।

তিনি বার্মা সরকারের যেকোনো আক্রমণ মোকাবেলার জন্য বাঁকখালী নদীর তীরে সেনা ঘাঁটি স্থাপনের সুপারিশ করেন। তিনি রামু থেকে উখিয়াঘাট ও নাফ নদী পর্যন্ত তীর থেকে ৩০ মাইল দূরত্ব রেখে একটা রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করেন। অবশ্য আগে লেফটেন্যান্ট টমাস ব্রগহাম এ রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করেছিলেন। এ রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব বোর্ড অব রেভিনিউ সমর্থন করে। রাস্তা নির্মাণের কাজে কক্স উদ্বাস্তুদের নিয়োগ করেন। রামু থেকে উখিয়াঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে উদ্বাস্তুদের ব্যবহারের জন্য বোর্ড অব রেভিনিউ ঢাকার কালেক্টরকে ৩ হাজার ৫০০টি কোদাল প্রেরণের নির্দেশ দেন।

উদ্বাস্তুদের ব্যক্তিগত জীবনে তাদের আইন ও প্রথাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে এখানকার আইনকে, প্রথাকে উপেক্ষা করা হয়নি—সমন্বয় সাধনের একটি শর্ত লক্ষ করা যায়। ক্যাপ্টেন কক্স সঠিকভাবে কোম্পানির স্বার্থ স্বীকার করে পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনা করেন। তিনি রামু থেকে উখিয়াঘাট পর্যন্ত প্রস্তাবিত রাস্তার দুই পাশে উদ্বাস্তুদের বসতি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি আদর্শ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বনভূমি পরিষ্কার ও আবাদের জন্য উদ্বাস্তুদের ২০০ কুঠার, ১০০ কাটারি, ১২ খানা বড় কাঁচি, ২০টি করাত, ৫০টি সুচালো কুঠার, ১০০টি কোদাল এবং চারটি শানপাথর দেয়া হয়।’২

তিনি আরাকানি উদ্বাস্তুদের পেশাভিত্তিকভাবেই পুনর্বাসন করেন। এ সময় বর্তমান কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ কূল ঘেঁষে অনেক উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন করেন। এ সময় তিনি বাঁকখালী নদীর তীরে একটি বাজারের পত্তন করেন এবং বাজারের সন্নিকটে পাহাড়ের ওপর বৌদ্ধমন্দির স্থাপন করেন। হিরাম কক্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সেই মন্দিরটির নাম ‘মহাসিংদ্রোগি’। বর্তমানে ‘মহাসিংদ্রোগি’ বৌদ্ধমন্দিরকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার শহরের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছে।

ক্যাপ্টেন কক্স রামুর অফিসে বসেই তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। তিনি অফিসের সঙ্গেই তার থাকার ব্যবস্থা করেন। আরাকানি উদ্বাস্তুদের সম্পূর্ণ পুনর্বাসনের আগেই বর্ষা মৌসুম শুরু হয়। এতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স প্রায় বিনা চিকিত্সায় ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। রামুর বাঁকখালী নদীর তীরে কক্সকে সমাহিত করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। বাঁকখালী নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ভাঙনে সেই সমাধি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

হিরাম কক্স মারা যাওয়ার পর ঢাকার রেজিস্ট্রার মি. কার হিরাম কক্সের স্থলাভিষিক্ত হন। আর এরই মধ্যে হিরাম কক্স প্রতিষ্ঠিত বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে মি. কারও বাজারের নাম ‘কক্স সাহেবের বাজার হিসেবে রেখে দেন।’ পরবর্তীকালে বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার থেকে ‘কক্সবাজার’-এ রূপ লাভ করে।

রামুর অফিসের চর

আগেই উল্লেখ করেছি, হিরাম কক্স বার্মিজ শরণার্থীদের পুনর্বাসন করার জন্য রামুতে এসে একটি বাংলোতে অবস্থান নেন। অনেকেই ওই বাংলোকে ‘হিরাম কক্স’-এর বাংলো বলে মনে করেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়। হিরাম কক্স রামুতে আসার অনেক আগেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শরণার্থীদের দেখভাল করার জন্য তাদের কর্মকর্তাদের জন্য একটি অফিস তথা আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

ব্রিটিশ জরিপকারী ফ্রান্সিস বুকানন ৭-৮ এপ্রিল, ১৭৯৮ রামুতে পৌঁছে কোম্পানির সেই অফিসেই অবস্থান নিয়েছিলেন। এতে এটা স্পষ্ট যে হিরাম কক্স যে অফিসে বা আবাসনে অবস্থান নিয়েছিলেন তা তিনি নির্মাণ করেননি। কোম্পানির সেই অফিসের কারণে রামু উপজেলা সদরের ওই স্থানের নাম হয়েছে ‘অফিসের চর’।

কূটনীতিতে অবিবেচক হিরাম কক্স

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন :

বার্মার রাজাকে লেখা জন শোরের চিঠি নিয়ে রেঙ্গুনে হাজির হলেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। এনবি এডমনস্টোন কর্তৃক বার্মার প্রধানমন্ত্রী ও রেঙ্গুনের প্রশাসককে লেখা আরো দুটি চিঠি তার সঙ্গে ছিল। জন শোর  তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা অঞ্চলের গভর্নর জেনারেল। এডমনস্টোন রাজনৈতিক সচিব। জন শোরের চিঠিতে কক্সের কাজের একটি তালিকা ছিল। ব্রিটিশদের সঙ্গে বার্মা রাজদরবারের সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছিল ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের মূল কাজ। পাশাপাশি বার্মা মুলুকে ফরাসিরা যেন প্রভাবশালী হতে না পারে, তা নিশ্চিত করাও তার বিশেষ দায়িত্ব ছিল। বার্মার বন্দরগুলোতে ফরাসি জাহাজের নোঙর করা ও পণ্য বিক্রি করা প্রতিরোধ করতে তাকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

হিরাম কক্সের বার্মা মিশন প্রসঙ্গে গবেষক জিপি রামচন্দ্র ‘ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সেস মিশন টু বার্মা, ১৭৯৬-১৭৯৮, আ কেস অব ইরেশনাল বিহেভিয়র ইন ডিপ্লোমেসি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘দুটি সরকারের মধ্যে সমঝোতা বাড়ানো ও নিশ্চিত করার জন্য কক্সকে পাঠানো হয়েছিল। কলকাতার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ কক্সের মাধ্যমে করার জন্য রাজাকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বাণিজ্যিক ভূমিকার দিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। রাজাকে আরো অনুরোধ করা হয়েছিল, কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কক্সকে মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা করতে রাজকর্মচারীদের যেন তিনি নির্দেশ দেন।’

বার্মায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের যাত্রা কীভাবে হলো, তার একটি প্রেক্ষাপট রামচন্দ্র তার নিবন্ধে হাজির করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৭৯৫ সালের শুরুতে জন শোর ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমসকে রেঙ্গুনে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শোরের মতে, বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একজন প্রতিনিধি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। দুটি সরকারের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগও সে নিশ্চিত করতে পারবে।

১৭৯৪ সালে তৈরি হওয়া সীমান্ত সংকটের সময় ব্রিটিশরা বার্মা রাজদরবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সরকারের সঙ্গে নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক স্থাপন করা ব্রিটিশদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। রেঙ্গুনে ব্রিটিশদের একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করার ব্যাপারে বার্মা রাজদরবারের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন সাইমস। শোরের কাছে লেখা চিঠিতে বার্মা মন্ত্রিসভা এভাবে অনুমোদন প্রদান করে, “বাণিজ্যিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং যোগাযোগে মধ্যস্থতা করা হবে নিযুক্ত প্রতিনিধির কাজ”।’ উল্লেখ্য, ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূত হিসেবে ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমসকে বার্মায় পাঠানো হয়েছিল।

বার্মা সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর জন শোর বার্মায় একজন প্রতিনিধি পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। ১৭৯৬ সালের জুন মাসে প্রতিনিধি মনোনীত হলেন বেঙ্গল আর্মির সদস্য ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। তার বয়স তখন ৩৭ বছর। সে বছরের ২৭ জুন ও ১২ সেপ্টেম্বরে কোম্পানির কলকাতা প্রশাসন এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এসব নীতিতে নানাভাবে প্রতিনিধির ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। বার্মা সরকারের দিক থেকে কোনো ধরনের সন্দেহ বা শত্রুতার সূত্রপাত যেন না হয়, সে লক্ষ্যে এমনটা করা হয়েছিল।

কক্সের মর্যাদা ও ক্ষমতার বিবরণ দিতে গিয়ে রামচন্দ্র লিখেছেন, ‘কলকাতা প্রশাসন কক্সকে ভালো পদমর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু তারা এটি স্পষ্ট করেছিল যে তার মর্যাদা রাষ্ট্রদূতের সমান নয়। কক্স বার্মার মন্ত্রী ও প্রশাসকদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে ফিরতি সাক্ষাতের দাবি জানাতে পারবেন না। তবে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এ নীতি কার্যকর হবে না।’ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে আরো জানানো হয়েছিল যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমস যেসব সুবিধা পেতেন, হিরাম কক্স সেগুলো দবি করতে পারবেন না।

তবে হিরাম কক্স তাকে দেয়া সব নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছিলেন। বার্মায় তিনি স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন। কূটনীতির ক্ষেত্রে তার এ আচরণকে রামচন্দ্র ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত এটি মনে হয় যে মিশনের সময় কক্স সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন না। বার্মায় তার আচরণ ছিল বাস্তবতাবিবর্জিত।’ অহেতুক সন্দেহ, অকারণে মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানো, পদমর্যাদার মোহ এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে রামচন্দ্র ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের ব্যক্তিত্বকে ‘অনেকাংশেই বিকারগ্রস্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তবে বার্মার রাজার দিক থেকে ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে সন্তুষ্ট করতে কোনো ত্রুটি ছিল না। রামচন্দ্র লিখেছেন, ‘রাজা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।…তিনি কক্সকে রেঙ্গুনে আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করার নির্দেশ দিলেন। রাজার সম্ভবত জানা ছিল যে, কক্সের মন্ত্রীর মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা আছে। তিনি তাকে সে পদমর্যাদায় ভূষিত করলেন। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজা তাকে প্রধানমন্ত্রীর সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন। আরেকটি প্রতিবেদন অনুসারে, তাকে ইচ্ছ মতো বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।’

এত সম্মান ও সুবিধা পেয়েও মন ভরেনি ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের। নিজের খামখেয়ালিপনা ও বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি বার্মার মন্ত্রীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। এমনকি সাধারণ মানুষও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অবশেষে তা রূপ নিয়েছিল চরম তিক্ততায়। তা কতটা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছিল, রামচন্দ্রের লেখায় তা এভাবে উঠে এসেছে, ‘কক্স বিশ্বাস করতেন যে রেঙ্গুনে তিনি মারাত্মক বিপদে আছেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তাকে বার্মা ত্যাগের অনুমতি দেয়া হবে না। এমনকি তাকে উদ্ধারকল্পে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে বলেছিলেন তিনি।…কক্স বার্মাকে শত্রু হিসেবে দেখার সুপারিশও করেছিলেন। অস্ত্র হাতে বর্মিদের মোকাবেলা করা ব্রিটিশদের কর্তব্য বলে তিনি লিখেছিলেন।’ মিশন পরিচালনায় ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে অবশেষে কক্সকে রেঙ্গুন থেকে প্রত্যাহার করে নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৯৮ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বার্মা ত্যাগ করেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স।

দাবা নিয়ে হিরাম কক্সের তত্ত্ব

নিজাম আশ শামস :

যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই শীত নেমে গেল। এত ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত নয় তারা। বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হলো। স্ত্রী-পরিজনবিবর্জিত সৈন্যরা অচিরেই অস্থির হয়ে উঠল। ঘরে ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিতে লাগল বারবার। বিপাকেই পড়ে গেলেন সেনাপতি হেমসিঙ। কিয়াংনানের রাজা হুঙ কোচির একজন মান্দারিন (রাজকর্মচারী) তিনি। রাজার নির্দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছেন সেনশি দখল করতে। অভিযান শেষ হওয়ার আগেই এমন দুর্বিপাক।

হেমসিঙ ভাবতে লাগলেন, বিরূপ পরিস্থিতিতে কীভাবে সৈন্যদের চাঙ্গা রাখা যায়। তাদের অশান্ত মনকে শান্ত করার উপায় বের করতে হবে তাকে। এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে, যা যুগপৎ সৈন্যদের প্রশান্ত করবে এবং তাদের সামরিক উদ্দীপনাও বজায় রাখবে। হেমসিঙ কেবল দক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না, যথেষ্ট জ্ঞান ও বিচক্ষণতাও ছিল তার। আর এ দুয়ের সমন্বয়ে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন একটি খেলা। এ যেন শুধু খেলা নয়, যুদ্ধের মহড়া! খেলতে হবে যুদ্ধের মূলনীতি অনুসরণ করে।

হেমসিঙের আবিষ্কৃত এ খেলা তার উদ্দেশ্য পূরণে শতভাগ সফল হয়েছিল। সৈন্যরা এ নতুন খেলা নিয়ে মেতে রইল। প্রকৃত রণাঙ্গনের একই ধরনের উন্মাদনায় মগ্ন হয়ে তারা ভুলে গেল সব প্রতিকূলতা। হাসি ফুটল হেমসিঙের মুখে। অবশেষে শীত পেরিয়ে এল বসন্ত। নতুন করে যুদ্ধের আয়োজন শুরু হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই সেনশিকে কিয়াংনান রাজ্যের অধীন করলেন হেমসিঙ। এ বিজয়ের পর কিয়াংনান অধিপতি হুঙ কোচি নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলেন। বিজয়ীর বেশে ফিরলেন সেনাপতি হেমসিঙ।

তখনো তিনি জানেন না, তার আবিষ্কৃত খেলাটি সাধারণ মানুষ কতটা ভালোবেসে গ্রহণ করবে। যুগে যুগে তাদের অবসরযাপনের অন্যতম চমত্কার উপায় হবে এ খেলা। ঘটনাটি আজ থেকে ১ হাজার ৯৬৫ বছর আগের, কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর। ততদিনে পেরিয়ে গেছে ৩৭০ বছর। ধরাধামে ঈসা মসিহর আবির্ভাব ঘটতে তখনো ১৭৪ বছর দেরি। উল্লেখ্য, কিয়াংনান ও সেনশি বর্তমানে চীনের দুটি প্রদেশ।

১৭৯৯ সালের ২৮ মে ব্রিটিশ প্রশাসক জন হারবার্ট হ্যারিংটনকে চট্টগ্রাম থেকে একটি চিঠি লেখেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। বিস্তৃত সে চিঠির একটি অংশে তিনি আইরিশ গবেষক আরভিনের বরাত দিয়ে দাবা খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। হিরাম কক্স কেবল ব্রিটিশ প্রশাসক ছিলেন না। তিনি একজন দাবাড়ু ও দাবা গবেষকও ছিলেন।

‘অন দ্য বার্মা গেম অব চেস’ শিরোনামের সে চিঠির আরেকটি অংশে তিনি উইলিয়াম জোনসের দোহাই দিয়ে দাবা খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি মিথের উল্লেখ করেছেন। সে মিথ অনুসারে, দাবা খেলার ধারণাটি লঙ্কার রাজা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর মস্তিষ্কপ্রসূত। ত্রেতা যুগে রাম লঙ্কা আক্রমণ করেন। যুদ্ধের ময়দানে রাবণের বাহিনী যখন রামের সেনাদলের মোকাবেলা করছে, তখন ঘরে বসেই যুদ্ধের স্বাদ নিতে মন্দোদরী আবিষ্কার করে ফেললেন চমত্কার বুদ্ধিবৃত্তিক খেলাটি। তবে দাবার উৎপত্তি প্রসঙ্গে এ দুই ঘটনার মধ্যে শেষোক্তটির পক্ষ নিয়েছেন হিরাম কক্স।

তিনি লিখেন, ‘খেলাটির উৎপত্তি লঙ্কায়, এ মতকেই আমি প্রাধান্য দিচ্ছি। কারণ উইলিয়াম জোনসের মতো গবেষকদের মতে, এটিই দাবাসম্পর্কিত প্রাচীনতম ঘটনা। আর পারস্যের অধিবাসীরা স্বীকার করেছে, তারা খেলাটি ভারতীয়দের থেকে গ্রহণ করেছে। আমি জানি, লন্ডনের আর্কিওলজিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্যারিংটন সাহেব চীনের দাবা খেলাটিকে সর্বপ্রাচীন বলে দাবি করেছেন। এ খেলার আবিষ্কারক হিসেবে প্রাচীন গ্রিকদের দাবিকে খারিজ করার জন্য তিনি যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেছেন। কিন্তু চীনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি ও রয়েল আইরিশ একাডেমিতে সংরক্ষিত আরভিনের প্রবন্ধ অনুসারে, চীনারা খেলাটির উৎপত্তির তারিখ নির্ধারণ করে নিজেদের দাবিকেই বাতিল করে দিয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৭৪ অব্দে তারা খেলাটি আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করে।’ হিরাম কক্সের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গ্রিস, চীন ও পারস্যের বহু আগেই ভারতবর্ষে দাবার উৎপত্তি ঘটেছে। সেখান থেকেই কালক্রমে দাবা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে নিজের মতকেই সবার ওপরে চাপিয়ে দিতে চাননি ক্যাপ্টেন কক্স। ভবিষ্যতের গবেষকদের তিনি এ খেলার উৎপত্তি নিয়ে অধিকতর গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বর্তমানে পাওয়া তথ্য অনুসারে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। আমার সামর্থ্য অনুসারে আমি এশিয়া অঞ্চলের দাবা খেলার চারটি প্রধান রূপ ও তাদের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি।

প্রথমত, উইলিয়াম জোনস উল্লেখিত পুরাণে প্রাপ্ত রূপ; দ্বিতীয়ত, জনাব আরভিন বর্ণিত চীনের দাবা খেলা; তৃতীয়ত, বার্মার অধিবাসীদের অনুসৃত পদ্ধতি এবং সর্বশেষ, পারসি বা বর্তমান হিন্দুস্তানিদের দাবা খেলার রীতি-নীতি ও পদ্ধতি। আমি দাবা খেলার এসব রূপের তুলনা করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি ইংরেজদের দাবা খেলার সঙ্গে এসব খেলার পার্থক্য ও মিল চিহ্নিত করেছি। এগুলোর মধ্যে কোনটি আদি রূপ, তা নির্ধারণের ভার ভবিষ্যতের অধিকতর সৌভাগ্যবান কোনো গবেষকের জন্য আমি ছেড়ে দিচ্ছি।’ ইংরেজদের দাবা খেলা বলতে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স দাবা খেলার বর্তমান রূপটিকেই বুঝিয়েছেন।

দাবা খেলার প্রাচীন নাম চতুরঙ্গ। এটি সংস্কৃত শব্দ। আভিধানিক অর্থে চতুরঙ্গ বলতে একটি সেনাবাহিনীর চারটি অংশকে বোঝায়—গজ, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনী। উইলিয়াম জোনসের সূত্রে পাওয়া এ তথ্য আমলে নিয়ে ক্যাপ্টেন কক্স জানান, ভারতে খেলাটি চতুরাজি নামেই অধিক পরিচিত ছিল। চতুরাজি অর্থ চার রাজা। চারজন মিলে এ খেলা হতো। চতুরঙ্গ বা চতুরাজির বর্ণনা দিতে গিয়ে হিরাম কক্স জানান, এ খেলার বোর্ড চতুর্ভুজ আকৃতির। তিনি লক্ষ করেন, ইংরেজদের দাবা খেলার সঙ্গে চতুরঙ্গের মূল পার্থক্য হলো, এ খেলায় চার রাজা ও তাদের সেনাদলের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। অথচ আধুনিক দাবায় থাকে দুই রাজা। তবে চতুরঙ্গে রাজার সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও মোট ঘুঁটির সংখ্যায় কোনো হেরফের হয় না। বরং ৩২টি ঘুঁটিই আটটি করে চার ভাগে বিভক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দাবায় রানী (কুইন) যে অবস্থানে থাকে, চতুরঙ্গে সে অবস্থানে থাকে হাতি। চতুরঙ্গের হাতি ও দাবার রানী সমান ক্ষমতাধর। তৃতীয়ত, বর্তমান দাবার ক্যাসলের পরিবর্তে চতুরঙ্গে থাকে নৌকা (বোট)। সে নৌকার ক্ষমতা আবার বিশপের সমতুল্য। অর্থাৎ কোনাকুনি আসা-যাওয়া করতে পারে। তবে চতুরঙ্গের নৌকা প্রতি চালে কেবল দুই ঘর যেতে পারে।

চতুর্থত, দাবা খেলার বর্তমান নিয়মানুসারে, কোনো বোড়ে যদি প্রতিপক্ষের শেষ সারিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে, তবে তা যেকোনো শক্তিধর ঘুঁটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু চতুরঙ্গের বোড়ে প্রতিপক্ষের শেষ সারির যে ঘরে গিয়ে পৌঁছায়, কেবল সে ঘরের জন্য বরাদ্দ ঘুঁটিতেই পরিণত হতে পারে। পঞ্চমত, আধুনিক দাবায় একজন দাবাড়ু স্বাধীনভাবে চাল দিতে পারেন। কিন্তু চতুরঙ্গে সে স্বাধীনতা নেই। চতুরঙ্গের প্রতিটি চাল নির্ধারিত হয় পাশার মাধ্যমে। প্রতিবার চাল দেয়ার আগে পাশা নিক্ষেপ করতে হবে। পাঁচ উঠলে রাজা কিংবা বোড়ের চাল দিতে হবে। চার উঠলে দিতে হবে হাতির চাল। তিন ও দুইয়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ঘোড়া ও নৌকা চালতে হবে। আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, আধুনিক দাবার মতো চতুরঙ্গে ক্যাসলিং (কিং ও ক্যাসলের পারস্পরিক স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে কিংকে অধিক নিরাপদ করার পদ্ধতি) করার কোনো নিয়ম নেই।

এবার দেখা যাক, দাবা খেলার চীনা রূপটি কেমন ছিল। আইরিশ গবেষক আরভিনের নিবন্ধের আলোকে হিরাম কক্স জানান, চীনে দাবাকে বলা হতো চোং-কি, অর্থাৎ রাজকীয় খেলা। তবে ক্যাপ্টেন কক্স খেলাটির আরেকটি চীনা নাম আবিষ্কার করেন—চোকে-চুহোং-কি তথা যুদ্ধবিজ্ঞানের খেলা। দাবা খেলার বোর্ডের তুলনায় চোং-কির বোর্ডে বেশ তফাত আছে। এ বোর্ডের মাঝামাঝি একটি খাদ থাকে। অনেকে এটিকে নদীও বলে থাকেন। ঘুঁটিগুলোর অবস্থান, শক্তি ও চালেও আছে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। চোং-কি বা চোকে-চুহোং কি খেলায় প্রতি দলের পেছনের সারিতে আটটির পরিবর্তে নয়টি ঘুঁটি থাকে। আর এ ঘুঁটিগুলো বর্গের পরিবর্তে রেখায় অবস্থান করে। এসব রেখা ধরেই খেলাটি খেলতে হয়। দাবা খেলার চীনা রূপে রাজাকে বলা হয় চোং বা চুহোং।

চোং পেছনের সারির মাঝামাঝি অবস্থান করে। তার চাল আধুনিক কিংয়ের অনুরূপ। তবে পার্থক্য হলো, চোং তার জন্য বরাদ্দ দুর্গের মধ্যেই কেবল চলাচল করতে পারে। আধুনিক কিংয়ের মতো সর্বত্র বিচরণ করতে পারে না। চোংয়ের দুই পাশে থাকে সমান ক্ষমতাধর দুই রাজকুমার। এদের বলা হয় সাও। তাদের চালও চুহোংয়ের দুর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আধুনিক দাবায় যে দুটি স্থানে বিশপ থাকে, চোং-কিতে সেখানে থাকে মান্দারিন (রাজকর্মচারী)। এদের অপর নাম শং। তাদের চালও বিশপের মতোই কোনাকুনি। পার্থক্য হলো তারা বোর্ডের মাঝখানের নদী বা সাদা অংশটি অতিক্রম করে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে পারে না। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করাই তাদের দায়িত্ব। আর প্রতি চালে তারা কেবল দুই ঘর যেতে পারে। দাবার ঘোড়াকে চোং-কিতে বলা হয় মায়ি। তাদের শক্তি ও চালও আধুনিক ঘোড়ার অনুরূপ। তারা প্রতিপক্ষের সীমানায়ও প্রবেশ করতে পারে।

দাবা খেলার চীনা রূপে ক্যাসলকে বলা হয় শে। ক্যাসল ও শের ক্ষমতা ও চাল একই রকম। চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কিতে পাউ নামে দুটি ঘুঁটি থাকে। এরা গোলন্দাজ সৈন্য হিসেবে কাজ করে। পাউ সোজা বা তির্যকভাবে সারা বোর্ডে বিচরণ করতে পারে। চলার পথে প্রতিপক্ষের কোনো ঘুঁটি বা বোড়ে থাকলে পাউ তাকে বন্দি করে নিজেদের সীমানায় নিয়ে আসে। বোড়েকে চীনারা বলে পিং। এর অর্থ পদাতিক সৈন্য। তারা প্রতি চালে এক ঘর যেতে পারে। তবে আধুনিক দাবার বোড়ের মতো পিং কোনাকুনি প্রতিপক্ষের সৈন্যদের কব্জা করতে পারে না। বরং পাশাপাশি ডানে বা বামে থাকা শত্রুসেনাকে তারা ঘায়েল করতে পারে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো দাবার বর্তমান নিয়মানুসারে তারা প্রতিপক্ষের শেষ সারিতে পৌঁছা সত্ত্বেও অন্য কোনো শক্তিতে পরিণত হতে পারে না। আধুনিক দাবার আটটি বোড়ের পরিবর্তে চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কি খেলায় পাঁচটি পিং থাকে।

এ খেলার বোর্ডের মাঝখানের প্রতীকী খাদ বা নদীকে চীনারা হোয়া কি বলে। শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এটি তৈরি করা হয়। ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সেনারা একটি কাঠের সেতুর (প্রতীকী) ওপর দিয়ে নদীটি পার হতে পারে। তবে সেতুটি হাতির (মান্দারিন) ভার বহন করতে পারে না। তাই তারা নিজেদের সীমানার মধ্যে থেকে আক্রমণ প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করে। তবে দাবার বর্তমান নিয়মের মতোই চোকে-চুহোং-কি খেলায়ও প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস বা রাজাকে (চুহোং) বন্দি করার মাধ্যমেই খেলার সমাপ্তি ঘটে। গোলাকার ঘুঁটিগুলো কাঠ বা হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি। প্রতিটি ঘুঁটির গায়ে নাম লেখা থাকে।

চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কির পরে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স আমাদের চিৎ-তা-রিন সম্পর্কে জানান। বার্মায় দাবাকে এ নামে ডাকা হয়। সাধারণত প্রধান সেনাপতি বা যুদ্ধ বোঝাতে তারা অভিধাটি ব্যবহার করে। তবে অনেকেই শব্দটিকে সংস্কৃত চতুরঙ্গ শব্দের অপভ্রংশ মনে করেন। দাবার বর্মি রূপে রাজাকে বলা হয় মিং। তার চাল ও শক্তি আধুনিক দাবার কিংয়ের অনুরূপ। তবে মিং ক্যাসলিং করতে পারে না। চেকয় নামে এক ধরনের ঘুঁটি আছে। সে কোনাকুনি সামনে-পেছনে চলাচল করতে পারে। কিন্তু প্রতি চালে কেবল এক ঘর যেতে পারে। বর্তমান দাবার ক্যাসেলের সমান শক্তি ও অনুরূপ চালের অধিকারী ঘুঁটিগুলোকে বর্মিরা বলে রথ। হাতিকে তারা বলে ছেইন। চিৎ-তা-রিনে ঘোড়াকে বলা হয় মি। তাদের ক্ষমতা ও চাল বর্তমান দাবা খেলার ঘোড়ার অনুরূপ। তবে আধুনিক দাবার সঙ্গে চিৎ-তা-রিনের পার্থক্য হলো এখানে স্বাধীনভাবে ঘুঁটিগুলোকে সাজানো যায়। নির্দিষ্ট স্থানে তাদের বসানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজস্ব কৌশল অনুসারে নিজেদের সীমানার মধ্যে যেকোনো স্থানে সেনা মোতায়েন করতে পারে দুটি দল।

চিঠিতে সবশেষে দাবার পারস্য সংস্করণের ওপর আলোকপাত করেছেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। পারসিরা দাবা খেলা ও বোর্ড উভয়টিকেই শতরঞ্জ বলে। এ খেলার রাজা শাহ বা পাদশাহ উপাধিতে পরিচিত। শাহর ক্যাসলিং করার কোনো সুযোগ নেই। ফির্জ বা উজিরের চালের মাধ্যমে খেলা শুরু হয়। সে সামনের দিকে এক ঘর বাড়তে পারে। তার পেয়াদাও তখন সামনে এক ঘর অগ্রসর হয়। তার পর থেকে ফির্জ বা উজির কেবল কোনাকুনি চলাচল করতে পারে। তবে প্রতি চালে এক ঘরের বেশি যেতে পারে না। এক্ষেত্রে শতরঞ্জের ফির্জের সঙ্গে চিৎ-তা-রিনের চেকয়ের মিল আছে।

হাতিকে পারসিরা ফিল বলে। তারা কোনাকুনি প্রতি চালে দুই ঘর যেতে পারে। তাদের চলার পথে অন্য কোনো ঘুঁটি থাকলেও তারা তা টপকে যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে চোং-কির পাউয়ের মিল আছে। ঘোড়াকে তারা বলে আসপ। তাদের শক্তি ও চাল বর্তমান নাইটের অনুরূপ। আধুনিক দাবার ক্যাসলের সমান শক্তিধর ও অনুরূপ চালসম্পন্ন ঘুঁটিকে তারা রুক বলে অভিহিত করে। বোড়েকে তারা বলে পেয়াদা। শতরঞ্জের সমাপ্তি প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স লেখেন, ‘যখন রাজাকে চেক দেয়া হয়, তারা বলে “শাহ, শাহ” বা “কিস্ত”। আর যখন চেকমেট হয়ে যায়, তারা বলে “শাহ-মাত”।’

দাবার এ প্রধান চার রূপের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ও আধুনিক দাবার সঙ্গে তাদের মিল-অমিল চিহ্নিত করার পাশাপাশি ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তার চিঠিতে এ খেলায় ব্যবহূত বিভিন্ন শব্দ ও অভিধা নিয়েও কথা বলেছেন। ১৮০১ সালে ‘অন দ্য বার্মা গেম অব চেস’ শিরোনামে ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’-এ প্রকাশিত তার এ চিঠি দাবা খেলার উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও রূপভেদ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সেখানে তিনি যে তত্ত্ব হাজির করেছেন, তা দাবার ‘কক্স-ফোর্বস তত্ত্ব’ নামে বিখ্যাত।