সূরা আল জাসিয়াহ (অর্থ, নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

নামকরণ
২৮ আয়াতের (আরবী) বাক্যাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে । অর্থাৎ এটি সেই সূরা যার মধ্যে ‘জাসিয়াহ’ শব্দ আছে ।

নাযিলের হওয়ার সময়-কাল
এ সূরাটির নাযিল হওয়ার সময়-কাল কোন নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়নি । তবে এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় এটি সুরা ‘দুখান’ নাযিল হওয়ার অল্প দিন পরই নাযিল হয়েছে । এ দুটি সূরার বিষয়বস্তুতে এতটা সাদৃশ্য বর্তমান যে সূরা দুটিকে যমজ বা যুগ্ম বলে মনে হয় ।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে মক্কার কাফেরদের সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তির জবাব দেয়া এবং কুরআনের দাওয়াতের বিরুদ্ধে তারা যে নীতি ও আচরণ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে সতর্ক করা ।

তাওহীদের সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে । এ প্রসঙ্গে মানুষের নিজের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শনের প্রতি ইংগিত দিয়ে বলা হয়েছে, যেদিকেই চোখ মেলে তাকাও না কেন তোমরা যে তাওহীদ মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছো প্রতিটি বস্তু তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে । নানা রকমের এসব জীবন-জন্তু, এই রাতদিন, এই বৃষ্টিপাত এবং তার সাহায্যে উৎপন্ন উদ্ভিদ রাজি, এই বাতাস এবং মানুষের নিজের জন্ম এর সবগুলো জিনিসকে কোন ব্যক্তি যদি চোখ মেলে দেখে এবং কোন প্রকার গোঁড়ামি বা অন্ধ আবেগ ছাড়া নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এসব নিদর্শন তার মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট যে এই বিশ্ব জাহান খোদাহীন নয় বা এখানে বহু খোদায়ী চলছে না, বরং এক আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই এর ব্যবস্থাপক ও শাসক । তবে যে ব্যক্তি মানবে না বলে শপথ করেছে কিংবা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কথা ভিন্ন । দুনিয়ার কোন জায়গা থেকেই সে ঈমান ও ইয়াকীনের সম্পদ লাভ করতে পারবে না ।

দ্বিতীয় রুকূ’র শুরুতে বলা হয়েছে, এই পৃথিবীতে মানুষ যত জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করছে এবং এই বিশ্ব জাহানে যে সীমাসংখ্যাহীন বস্তু ও শক্তি তার স্বার্থের সেবা করছে তা আপনা আপনি কোথাও থেকে আসেনি বা দেব-দেবীরাও তা সরবরাহ করেনি, বরং এক আল্লাহই তাঁর নিজের পক্ষ থেকে তাকে এসব দান করেছেন এবং এসবকে তার অনুগত করে দিয়েছেন । কেউ যদি সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার বিবেক-বুদ্ধিই বলে দেবে, সেই আল্লাহই মানুষের প্রতি অনুগ্রহকারী মানুষ তাঁর শোকর গোজারী করবে এটা তাঁর প্রাপ্য ।
এরপর মক্কার কাফেররা হঠকারিতা, অহংকার, ঠাট্টা-বিদ্রূপ এবং কুফরকে আঁকড়ে ধরে থেকে কুরআনের দাওয়াতের যে বিরোধিতা করছিলো । সে জন্য তাদেরকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছে এবং সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, এ কুরআন সেই নিয়ামত নিয়ে এসেছে যা ইতিপর্বে বনী-ইসরাঈলদের দেয়া হয়েছিলো যার কল্যাণে বনী ইসরাঈলরা গোটা বিশ্বের সমস্ত জাতির ওপর মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলো । কিন্তু তারা এই নিয়ামতের অমর্যাদা করেছে এবং দীনের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি করে তা হারিয়ে ফেলেছে । তাই এখন তা তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে । এটা এমন একটি হিদায়তনামা যা মানুষের দীনের পরিষ্কার রাজপথ দেখিয়ে দেয় । নিজেদের অজ্ঞতা ও বোকামির কারণে যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তারা নিজেদেরই ধ্বংসের আয়োজন করবে । আর আল্লাহর সাহায্য ও রহমতের উপযুক্ত বিবেচিত হবে কেবল তারাই যারা এর আনুগত্য করে তাকওয়ার নীতি ও আচরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে ।

এ ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হয়েছে, এসব লোক আল্লাহকে ভয় করে না । এরা তোমাদের সাথে যে অশোভন আচরণ করছে তা উপেক্ষা করো এবং সহিষ্ণুতা অবলম্বন করো । তোমরা ধৈর্য অবলম্বন করলে আল্লাহ নিজেই এদের সাথে বুঝাপড়া করবেন এবং তোমাদের এই ধৈর্যের প্রতিদান দিবেন ।

তারপর আখেরাত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কাফেরদের জাহেলী ধ্যান-ধারণা আলোচনা করা হয়েছে । কাফেররা বলতোঃ এই দুনিয়ার জীবনই সব । এরপর আর কোন জীবন নেই । যুগের বিবর্তনে আমরা ঠিক তেমনি মরে যাব যেমন একটি ঘড়ি চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যায় । মৃত্যুর পরে রূহের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না যে, তা কবজ করা হবে এবং পুনরায় কোন এক সময় এনে দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হবে । তোমরা যদি এ ধরনের দাবী করো তাহলে আমাদের মৃত বাপ দাদাদের জীবিত করে দেখাও । এর জবাবে আল্লাহ একের পর এক কয়েকটি যুক্তি পেশ করেছেনঃ

একঃ কোন জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে তোমরা একথা বলছো না, বরং শুধু ধারণার ভিত্তিতে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছ । সত্যিই কি তোমাদের জানা আছে যে, মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন নেই এবং রূহ কবজ করা হয় না, বরং ধ্বংস হয়ে যায়?

দুইঃ তোমাদের এই দাবীর ভিত্তি বড় জোর এই যে, তোমরা কোন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে দেখোনি । এতটুকু বিষয়ই কি এতবড় দাবী করার জন্য যথেষ্ট যে মৃতরা আর কখনো জীবিত হবে না? তোমাদের অভিজ্ঞতায় ও পর্যবেক্ষণে কোন জিনিস ধরা না পড়ার অর্থ কি এই যে, তোমরা তার অস্তিত্বহীন হওয়ার জ্ঞান লাভ করছো?
তিনঃ এ কথা সরাসরি বিবেক-বুদ্ধি ও ইনসাফের পরিপন্থী যে ভাল ও মন্দ, অনুগত ও অবাধ্য এবং জালেম ও মজলুম সবাইকে শেষ পর্যন্ত একই পর্যায়ভুক্ত করে দেয়া হবে । কোন ভাল কাজের ভাল ফল এবং মন্দ কাজের মন্দ কাজের মন্দ ফল দেখা দেবে না । কোন মজলুমের আর্তনাদ শোনা হবে না কিংবা কোন জালেক তার কৃতকর্মের শাস্তি পাবে না । বরং সবাই একই পরিণাম ভোগ করবে । আল্লাহর সৃষ্টি এই বিশ্ব জাহান সম্পর্কে যে এই ধারণা পোষণ করে সে অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে । জালেম ও দুষ্কর্মশীল লোকদের এ ধারণা পোষণ করার কারণ হলো এই যে, তারা তাদের কাজ-কর্মের মন্দ ফলাফল দেখতে চায় না । কিন্তু আল্লাহর এই সার্বভৌম কর্তৃত্ব কোন অনিয়মের রাজত্ব নয় । এটি একটি ন্যায় ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে সৎ ও অসৎকে এক পর্যায়ভুক্ত করে দেয়ার মত জুলুম কখনো হবে না ।

চারঃ আখেরাত অস্বীকৃতির এই আকীদা নৈতিকতার জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক । এই আকীদা তারাই গ্রহণ করে যারা প্রবৃত্তির দাস হয়ে আছে । তারা এ আকীদা গ্রহণ করে এ জন্য, যাতে প্রবৃত্তির দাসত্ব করার অবাধ সুযোগ লাভ করতে পারে । কাজেই তারা যখন এ আকীদা গ্রহণ করে তখন তা তাদেরকে চরমতম গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে । এমনকি তাদের নৈতিক অনুভূতি একেবারেই মরে যায় এবং হিদায়াত লাভের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায় ।

এসব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পর আল্লাহ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, যেভাবে তোমরা নিজে নিজেই জীবন লাভ করোনি, আমি জীবন দিয়েছি বলে জীবন লাভ করছো, তেমনি নিজে নিজেই মরে যাবে না, বরং আমি মৃত্যু দেই বলে মারা যাও এবং এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন তোমাদের সবাইকে যুগপৎ একত্র করা হবে । আজ যদি মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে তোমরা একথা না মানতে চাও তাহলে মেনো না । কিন্তু সে সময়টি যখন আসবে তখন নিজের চোখেই তোমরা দেখতে পাবে যে, তোমরা তোমাদের আল্লাহর সামনে হাজির আছো এবং কোন প্রকার কমবেশী ছাড়াই তোমাদের পুরো আমলনামা প্রস্তুত আছে, যা তোমাদের প্রতিটি কাজের সাক্ষ্য দিচ্ছে । সে সময় তোমরা জানতে পারবে আখেরাতের আকীদার এই অস্বীকৃতি এবং এ নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রূপ তোমরা করছো এর কত চড়া মূল্য তোমাদের দিতে হচ্ছে ।