ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকতে পারেন বদিও

আবদুল আজিজ,বাংলা ট্রিবিউন :

ইয়াবা গডফাদারদের তালিকায় ‘পৃষ্ঠপোষক’ –এর তালিকায় নাম থাকা  সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে এবার দলের মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনের পরেও আছেন আলোচনায়। যে ইয়াবা ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে টানা দশ বছর ধরে তিনি সমালোচিত, সেই ব্যবসায় সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে তাকেও অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। নতুন এই তথ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে আত্মসমর্পণে রাজি হওয়াদের পরিবার সদস্যসহ স্থানীয়দের মধ্যে।

টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী এবারে তার সরকারের যে কয়েকটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছেন তাতে একেবারে ওপরেই রয়েছে জঙ্গি দমন ও মাদক নির্মূলের প্রতিশ্রুতি। এই ঘোষণা আগের দুই মেয়াদে দেওয়া হলেও এবারের ‘জিরো টলারেন্স’ যে শুধুমাত্র কথার কথা হবে না তার ইঙ্গিত মিলেছে কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দেওয়া হলেও চাপটি যে প্রবল তা টের পাওয়া যাচ্ছে তালিকাভুক্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জেলা পুলিশ লাইনে পুলিশের জিম্মায় থাকা এসব ব্যবসায়ী এখন অপেক্ষা করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের জন্য।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে টেকনাফে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে অন্তত ১৫০ জনের নাম থাকতে পারে। তাদের মধ্যে আলোচিত বদির পরিবারের সাত সদস্য আছেন। বদি তালিকাভুক্ত হলেও আত্মসমর্পণ করবেন না। টেকনাফে হবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে বদির স্ত্রী শাহীন আক্তার বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন। অনুষ্ঠানে থাকতে পারেন বদিও’।

এই চাপ তৈরির কাজে সম্পৃক্ত আছেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিও। ‘ইয়াবা’ ইস্যুটি তার মনোনয়ন না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায় নিজেকে ‘‘দায়মুক্ত’ করতে স্ত্রীর একাধিক নির্বাচনি প্রচারণা সভা ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় এরইমধ্যে টেকনাফ তথা কক্সবাজার থেকে ইয়াবা নির্মূলের জন্য এই ব্যবসায় সম্পৃক্তদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন তিনি। এমনকি নিজের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে কমপক্ষে সাত জনকে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। তবে তালিকাভুক্ত থাকার কারণে তিনি নিজে আত্মসমর্পণ করবেন কিনা এ নিয়ে কোনও কথাই বলছেন না গণমাধ্যমের কাছে। তবে নিজেকে বার বার ‘নির্দোষ’ দাবি করেছেন আবদুর রহমান বদি। তার বদলে ওই আসনে মনোনয়ন পাওয়া তার স্ত্রী শাহীন আক্তারও দাবি করেছেন, তার স্বামী ‘নির্দোষ’।

মূলত একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন খোয়া যাওয়ার পরে ইয়াবা ইস্যুটি নিয়ে সরব হন আবদুর রহমান বদি। স্ত্রীর নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যারা ইয়াবা ব্যবসা করেন তারা যেন নৌকায় ভোট না দেন। টেকনাফকে ইয়াবার কলঙ্কমুক্ত করার আহ্বানও এসময় জানান তিনি। এসময় একাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছে প্রয়োজনে তিনি নিজেও আত্মসমর্পণ করবেন এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে টেকনাফ এলাকায় প্রচার রয়েছে। ‘ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ’ মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণে গেছেন এমন কিছু পরিবারের স্বজনরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন দাবি করেছেন। তবে গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ্যে এমন কিছু বলেননি সাবেক সংসদ সদস্য বদি। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের যে তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছে তাতে ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে ওপরের দিকেই আছে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নামও। এ তালিকায় কক্সবাজারের ১ হাজার ১৫১ ব্যক্তিকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি জোরালো হয়ে উঠে কক্সবাজারে। ইতোমধ্যে ২৩ জনপ্রতিনিধিসহ ও ৩০ জন গডফাদারসহ কক্সবাজারের অন্তত দেড় শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।  পুলিশের হেফাজতে চলে গেছেন আবদুর রহমান বদির দুই ভাইসহ পরিবারের সাত জন। আরও এক ভাই দুবাই থেকে ফিরে আত্মসমর্পণ করবেন বলে আলোচনা রয়েছে।

আইন -শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই আব্দুল আমিন, মোহাম্মদ ফায়সাল আত্মসমর্পণ করেছেন। দুবাই থেকে  আত্মসমর্পণের জন্য আসছেন আবদুস শুক্কুর নামে আরেকজন। এছাড়াও আত্মসমর্পণ করেছেন বদির ভাগ্নে  শাহেদুর রহমান নিপু, খালাতো ভাই ম. ম. সেন, মামাতো ভাই কামরুল হাসান, বেয়াই শাহেদ কামাল, ভাই আবদুস শুক্কুরের ম্যানেজার ইব্রাহিম খলিল, ‘ইয়াবা ডন’ নামে পরিচিতি পাওয়া নুরুল হুদা, এনাম মেম্বার, একরাম হুদা, বদিউর রহমান, মৌলভী নুর মোহাম্মদ, জামাল মেম্বার, মোহাম্মদ দানু মেম্বার ও টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে মোহাম্মদ দিদারসহ দেড় শতাধিক ব্যাক্তি। ‘ইয়াবা পাচারকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত এসব ব্যক্তিকে জেলা পুলিশ লাইনে  পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘ইয়াবা গডফাদার’ হিসেবে আলোচিত সাইফুল করিম, মৌলভী মুজিবুর রহমান, শাহাজাহান ও মোহাম্মদ আমিন আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদের মধ্যে আবুধাবি  ও দুবাই থেকে সাবেক সংসদ সদস্য বদির ভাই  আবদুস শুক্কুরের সঙ্গে আত্মসমর্পণের জন্য আসছেন সাইফুল করিম ও মোহাম্মদ আমিন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে আছে এদের নামও।

পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় কেবল টেকনাফ এলাকা থেকেই ৯১২ ব্যক্তির নাম রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত শ’ দুয়েক ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ করাতে চায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের জালে এরইমধ্যে দেড়শ ব্যক্তি আছেন বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির কত তারিখে অনুষ্ঠানটি হতে যাচ্ছে তার কোনও আভাস এখন পাওয়া যায়নি কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ঠিক না হওয়ায় তেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি এখনও।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কবে নাগাদ আত্মসমর্পণ করছে, এর কোনও দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনও একটি দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

ওই অনুষ্ঠানে আবদুর রহমান বদি অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন নাকি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবেন তা জানতে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে বর্তমান সংসদ সদস্য ও তার স্ত্রী শাহিন আকতার বলেন, ‘মাদকমুক্ত টেকনাফ গড়তে প্রথমে আমরাই তো আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নিয়েছি। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের জন্য উৎসাহ দিয়েছি। তবে আমার স্বামী (আবদুর রহমান বদি) নির্দোষ। তালিকায় তার নাম থাকলেও কোথাও প্রমাণ নেই। এটি সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে সবাই জানেন’।

আবদুর রহমান বদি ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে পর পর দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তার হাতে একের পর এক নিগৃহীত ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রিসাইডিং অফিসার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী লোকজন। এমন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন নিজ দলের নেতাকর্মীরাও। একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেওয়ার মাধ্যমেই মূলত জেলাব্যাপী মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেন সরকার দলীয় এই সাবেক সংসদ সদস্য। তবে ইয়াবা পাচার ও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় তার নাম আলোচিত হয় দেশজুড়ে। এছাড়াও সাগরপথে মানবপাচার, দেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্রয়, দলীয় নেতাকর্মী ও সরকারি আমলাদের মারধর এবং দুদকের দায়ের করা মামলা জেলসহ নানা অভিযোগে একাধিকবার আলোচনায় আসেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  মনোনয়ন পাননি তিনি।

গত ২০১৮ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার পর দেশব্যাপী একযোগে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে তালিকা করে তাতে কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্যের নাম রয়েছে। ওই তালিকায় ৭৩ ব্যক্তিকে শীর্ষ মাদক কারবারি বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্যের নাম রয়েছে। এছাড়া টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার নামও রয়েছে।  নির্বাচনি বছর হওয়ায় মাদক নির্মূলে তৎপরতাও বাড়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পরবর্তীতে একের পর এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটতে থাকলে গা ঢাকা দিতে থাকে সীমান্তের শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা।