উখিয়ায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপন

আজিম নিহাদ :
উখিয়া-টেকনাফে ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ জায়গায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সুষ্ঠু পয়:নিস্কাশন ব্যবস্থা নেই। একারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবসৃষ্ট বর্জ্যে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে টয়লেট গুলো স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো অস্বাস্থ্যকর। এসব টয়লেটে পয়:নিস্কাশনের সুযোগ না থাকায় মারাত্মক বায়ু দূষণ হচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে নানা রকম রোগব্যাধির আশঙ্কা থাকে। তাই মানবসৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
উখিয়ার ২৩ টি ও টেকনাফের ৭টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গার মধ্যে রোহিঙ্গারা অবস্থান করায় মানবজট সৃষ্টি হয়েছে। এই মানবজট থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পয়:বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর টয়লেটে পয়:বর্জ্যগুলো নিঃসরণ হওয়ায় ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণের এই সমস্যা সমাধানে সরকার তথা এনজিওগুলোর কার্যকর কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে প্রথমবারের মত রোহিঙ্গা শিবিরে ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় বৃহৎ আকারে পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে বেসরকারী সংস্থা অক্সফাম। কিন্তু বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এটি যথেষ্ট নয়।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত মানুষের পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বরাবরের মতোই সরকার ও অন্যান্য সংস্থার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বিষয়টিকে মাথায় রেখে ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় বেসরকারী সংস্থা অক্সফাম একটি সুরক্ষিত পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। প্রথমবারের মত স্থাপিত এই প্ল্যান্টটি পৃথিবীর যে কোনো শরণার্থী শিবিরের মধ্যে সর্ববৃহৎ।
অক্সফাম সূত্রে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালংস্থ ক্যাম্প ৪ (বর্ধিত) এলাকায় বিশাল জায়গার উপর এই প্ল্যান্টটি স্থাপন করা হয়েছে। ক্যাম্প-৩, ক্যাম্প-৪ ও ক্যাম্প-৪ (বর্ধিত) এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হবে এই প্ল্যান্টটিতে। প্রতিদিন ৪০ ঘণমিটার বর্জ্য হিসেবে সর্বোচ্চ দেড় লাখ মানুষের পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে এই প্ল্যান্টে। অনবরত ২০ বছর প্ল্যান্টটি ব্যবহার করা যাবে।
অক্সফামের মিডিয়া ও কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর এ জে এম জোবায়দুর রহমানের সোয়েব জানিয়েছেন, বিশে^র সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে প্রথমবাবের স্থাপিত প্ল্যান্টটি আজ মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মোহাম্মদ এনামুর রহমান। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনার মো. আবুল কালাম, বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের প্রধান স্টিভেন কর্লিসের।
পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জোবায়দুর রহমান সোয়েব জানান, পয়:বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করার জন্য বিশেষায়িত ট্রাক আছে। সেই ট্রাকে পাম্প ও ট্যাঙ্ক রয়েছে। সেই ট্রাক নিয়ে ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে পয়:বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করা হবে। পরে প্ল্যান্টের লেগুনের মধ্যে বর্জ্যগুলো ফেলা হবে। পয়:বর্জ্যরে দুটি ধরণ রয়েছে। একটি শক্ত ও অপরটি লিকুইড। শক্ত শ্রেণীর পয়:বর্জ্য থাকে ৩০ শতাংশ। আর লিকুইড শ্রেণীর পয়:বর্জ্য থাকে ৭০ শতাংশ। প্ল্যান্টের লেগুনে ফেলার পর এই দুটি শ্রেণীকে আলাদা করা হবে। এরমধ্যে শক্ত শ্রেণীর পয়:বর্জ্য গুলোকে প্রাকৃতিকভাবে এক ধরণের ফিল্টার করা হয়। শক্ত শ্রেণীর পয়:বর্জ্য থেকে বায়ু গ্যাস, জৈব সার বিভিন্ন কিছু উৎপাদন হবে। আর লিকুইড শ্রেণীর পয়:বর্জ্য গুলো কয়েক স্তরে পরিশোধিত হবে। পরিশোধিত করে যত ধরণের ক্ষতিকারক জীবানু আছে সেগুলো ধ্বংস করা হবে। এরপর সেগুলো পানি আকারের হয়ে বের হয়ে যাবে।  
তিনি আরও জানান, এই একটি মাত্র প্ল্যান্টে সবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। আরও কয়েকটি প্ল্যান্ট দরকার। তবে সরকারের উচিত একটি গবেষণা চালানো। গবেষণার মাধ্যমে দৈনিক প্রতিটি ক্যাম্প ভিত্তিক কি পরিমাণ পয়:বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার পরিসংখ্যান বের করা। এই পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে পুরো ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কতটা প্ল্যান্ট দরকার তার হিসাব পাওয়া যাবে।
পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা দীপক শর্মা দীপু বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপিত টয়লেট গুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এসব টয়লেটের দুর্গন্ধে পুরো ক্যাম্প বিষিয়ে উঠে। উখিয়া-টেকনাফে মারাত্মক বায়ু দূষণ হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে রোহিঙ্গাদের সৃষ্ট বর্জ্য গুলোর আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বৃষ্টির পানিতে সেগুলো নদী-খাল, বিলে ও সমুদ্রে চলে পতিত হয়। এরফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় বের করা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, অক্সফামের উদ্যোগটি ভাল। কিন্তু মাত্র দেড় লাখ রোহিঙ্গার পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করলেতো সমাধান হবে না। তাই সকল রোহিঙ্গা পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যতটি প্ল্যান্ট দরকার, সেগুলো স্থাপন করে বায়ু দূষণরোধ করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সিনিয়র কেমিস্ট মো. কামরুল হাসান বলেন, পুরো ক্যাম্পের মানবসৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা দরকার। এসব বর্জ্যরে কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।