এবার আত্মসমর্পণের সমন্বয়ক বদি

  • বদির তিন ভাইসহ ১০ আত্মীয় পুলিশি হেফাজতে
    আত্মসমর্পণকারীর সংখ্যা শতাধিক হতে পারে
    ★ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হতে পারে আত্মসমর্পণ
    ★ প্রচার ছিল বদি আত্মসমর্পণ করবেন, কিন্তু করছেন না
    ★ আত্মসমর্পণ নিয়ে এখন এলাকায় ভীতি তৈরি হয়েছে
    ★ আত্মসমর্পণকারীদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত তা পরিষ্কার নয়।

ভয়াবহ মাদক ইয়াবা বাণিজ্যের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে তালিকাভুক্ত টেকনাফের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি আত্মসমর্পণ করছেন না। তিনি সরকারের তালিকাভুক্ত অন্য ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় অনেকটা ‘সমন্বয়কের’ কাজ করছেন। তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাঁকে সমন্বয়ক বলতে নারাজ। তাদের ভাষায়, অন্য অনেকের মতো বদিও এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনকে সহায়তা করছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব কটি তালিকায় ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে চিহ্নিত আবদুর রহমান বদির দাবি, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে তিনি নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটিতে গত সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ইয়াবা সিন্ডিকেট মোটা টাকা ঢেলে প্রশাসনের বিভিন্ন তালিকায় অন্যায়ভাবে আমার নাম ঢুকিয়েছিল। আমি ইয়াবা ব্যবসা করি না। যাঁরা অপরাধী, তাঁরাই এখন আত্মসমর্পণ করবেন।’

তবে যাঁরা আত্মসমর্পণ করছেন এমন একাধিক ব্যক্তির আত্মীয়রা প্রথম আলোকে বলেছেন, শুরুতে তাঁরা জানতেন সাবেক সাংসদ বদিও আত্মসমর্পণ করবেন। কিন্তু এখন শুনছেন বদি আত্মসমর্পণ করবেন না। তাই আত্মসমর্পণকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। কারণ, এখন পর্যন্ত তাঁরা জানেন না, যাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন তাঁদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের তিন থেকে ছয় মাস জেল খাটার পর মাফ করে দিতে পারেন এমন প্রচারও আছে এলাকায়। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, বাইরে থাকলে ক্রসফায়ারের ভয় আছে, তার থেকে পুলিশের জিম্মায় থাকা ভালো।

এর আগে তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হলেও আবদুর রহমান বদিকে ধরেনি পুলিশ। তখন সরকারের তালিকাভুক্ত এই ‘পৃষ্ঠপোষক’কে নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়। টেলিভিশনের টক শোতেও চলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা। তবে তখন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের একটি মামলায় তিনি এক মাসের মতো জেল খাটেন।

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু চূড়ান্ত হলেও পুলিশ সপ্তাহের কারণে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা পেছানো হয়েছে। এখন ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো এক দিনে এটা হতে পারে। এতে শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করতে পারেন বলে তিনি আশা করছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আত্মসমর্পণের জন্য ধরা দেওয়া ৬৬ জনকে কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে রাখা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ২ থেকে ১৬টি পর্যন্ত মামলা আছে। এ তালিকায় কমপক্ষে পাঁচজন জনপ্রতিনিধি আছেন। আছেন আবদুর রহমান বদির তিন ভাই আবদুল আমিন, মো. শফিক ও মো. ফায়সাল; চাচাতো ভাই মো. আলম, খালাতো ভাই মং মং সিং, ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম, ভাগনে সাহেদুর রহমান, বেয়াই জামাল হোসেন, শাহেদ কামাল ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোয়াজ্জেন হোসেন। আত্মসমর্পণের জন্য বদির তিন ভাই দুবাই থেকে এসেছেন বলে জানা গেছে।

আবদুর রহমান বদি নিজেও এসব তথ্য স্বীকার করে বলেছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় স্থান পাওয়া তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছেন। যদিও আত্মীয় সংখ্যা কত এবং তাঁরা ইয়াবা ব্যবসা করেন কি না, সে সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। বদি বলেন, ‘ভাই-বোন-ভাগনে যাদের নাম এসে পড়ছে, আমি বলছি তোমরা আইনের আশ্রয় নিয়ে যাও। জড়িত আছে কি নেই, সেটা এখন বলব না। আদালতে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলেছি। পুলিশ ধরে…বাড়ি দিলেই তো সত্য কথা বলবে।’

তবে এখনো বাইরে আছেন বদির ছোট ভাই আবদুস শুক্কুর ও মৌলভি মুজিবুর রহমান, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, ছোট বোনের দেবর ছৈয়দ হোসেন মেম্বার ও বদির ভাই শুক্কুরের হিসাবরক্ষক মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু। তাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন কি না, তা জানা যায়নি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় থাকা গডফাদারদের ৭৩ জনের ৬৬ জনই টেকনাফের বাসিন্দা। গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সোমবার পর্যন্ত ২৪৩ দিনে ২৮৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে নতুন করে সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার উদ্যোগ শুরু করে।

আত্মসমর্পণ করতে পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছেন এমন তিনজন ব্যক্তির স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। টেকনাফের পুরাতন পল্লানপাড়ার এমন একজনের স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, বদির স্ত্রী সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়ে আসার পরপরই আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। টেকনাফে ফিরে বদি তাঁর আত্মীয়কে বলেন, পাঁচ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তিনি কারও কোনো দায়দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তিনি নিজেও আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানান। কাজেই প্রত্যেকেরই উচিত হবে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা চাওয়া। ১১ জানুয়ারি যারা আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে গেছে তাদের প্রথমে টেকনাফ আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরে কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়।

আত্মসমর্পণের এই মহড়া কাছ থেকে দেখছেন টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড এলাকার এক ব্যবসায়ী। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসও ওই এলাকায়। তিনি বলেন, দুপুরের পর আবদুর রহমান বদি গাড়িতে করে আওয়ামী লীগ অফিসে আসেন। তাঁর গাড়ির সামনে-পেছনে ছিল মোটরসাইকেলের বহর। বদির গাড়িতে তখন ছিল আত্মসমর্পণের জন্য যাওয়া নাজিরপাড়ার এনামুল হক। ওই একই দিন তাঁর ভাই মো. ফায়সালও আত্মসমর্পণের জন্য যান। তবে তিনি ওই গাড়িতে ছিলেন কি না, জানা যায়নি। পরে সেখান থেকে বদির গাড়ি কক্সবাজারের দিকে রওনা হয়। পেছনে ছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়ি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, বদির এই তৎপরতার সঙ্গে ওই টিভি চ্যানেলটির একজন সাংবাদিকও যুক্ত আছেন। আত্মসমর্পণকারীদের স্বজনেরা বলেছেন, ‘জানে বাঁচতে তাঁরা অভিযুক্ত স্বজনকে এমপি সাহেবের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

আবদুর রহমান বদি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শুধু নির্বাচনের পর তাদের রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করেছি। আমি বললাম, চোখের সামনে মানুষ মারা যাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীহারা হচ্ছে, সন্তান বাবাকে হারাচ্ছে, সব জায়গায় ক্রন্দনের সুর। তোমরা আর কত দিন এভাবে চলবা? তোমরা আত্মসমর্পণ করার চেষ্টা করো। আমি এ কথাটুকু বলেছি। তারা স্বেচ্ছায় যোগাযোগ করে ঢুকে গেছে।’ তিনি এ-ও বলেন, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য। এতে করে মানুষ ভয় পাচ্ছে এবং ধরা দিচ্ছে; এটা বেশ ভালো। চিহ্নিত সবাই আত্মসমর্পণ করবে বলেও জানান তিনি।

কী হবে কেউ জানে না
কমপক্ষে দুটি দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, পুলিশ লাইনসে আত্মসমর্পণের জন্য এ মুহূর্তে ৬৫ বা ৬৬ জন আছেন। বাকিরা কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না। পুলিশ লাইনসে থাকা লোকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহম্মদের ছেলে দিদার মিয়া, ভাইপো মে. সিরাজ, হ্নীলা ইউপির সদস্য নুরুল হুদা, জামাল হোসেন ও তাঁর ছেলে শাহ আজম, সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রেজাউল করিম, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দুই ভাই জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমান, টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ, নারী কাউন্সিলর কহিনুরের স্বামী শাহ আলম, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এনামুল হক ও হ্নীলার আবদুল্লাহ ও ছৈয়দ আহমদ।

পুলিশের তালিকায় দেখা গেছে, আবদুল আমিনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা আছে, নুরুল হুদা ও এনামুল হক ১১ মামলার আসামি, জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমান ৫টি মামলার আসামি। এ ছাড়া শাহ আলমের নামে ৪ টি, মো. জুবায়েরের নামে ১৬ টি, মোজাম্মেলের নামে ৪ টি, মং মং সিংয়ের নামে ৩টি ও সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা আছে। এই পাঁচজনের পরিবারে একজন করে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন।

গোদার বিলের দুই ভাই আবদুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গিয়ে সোমবার কোনো স্বজনের দেখা পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের এক আত্মীয় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি আবদুর রহমান বদি আত্মসমর্পণ করবেন। হিসাবে তা-ই হওয়ার কথা।’ এখন এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে তাঁদের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জালিয়াপাড়া থেকে আত্মসমর্পণকারী এক ব্যক্তির স্বজনেরাও জানিয়েছেন, আবদুর রহমান বদি দুবাইয়ে থাকা তাঁদের ওই আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি পেয়ে টেকনাফে ফিরে আত্মসমর্পণ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, বদির আত্মীয়স্বজনেরাও আত্মসমর্পণ করছেন। এটাই আপাতত তাঁদের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা তাঁরা জানেন না।

/প্রথম আলো