পর্যটননগরী কক্সবাজারের কর্তৃপক্ষ আছে, কর্তৃত্ব নেই

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল •

সৈকতে যেখানে-সেখানে দোকান। আছে ভিক্ষুক, ফটোগ্রাফার, ডাব, চিপস, বাদাম বিক্রেতাসহ ফেরিওয়ালাদের দৌরাত্ম্য। এভাবেই চলছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের ব্যবস্থাপনা। এই সৈকত ঘিরে কক্সবাজারকে একটি পরিকল্পিত আধুনিক পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) নামের একটি আলাদা সংস্থা। কিন্তু আইনি ক্ষমতা পাওয়ার ৭ বছর পরেও সৈকতের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারেনি সংস্থাটি। এই অবস্থায় আইন অনুযায়ী সৈকতের প্রশাসনিক ক্ষমতা ফিরে পেতে কয়েক মাস আগে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন কউক চেয়ারম্যান।

জানা গেছে, কক্সবাজারকে একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে এক আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সেই আইনের ক্ষমতাবলে সমুদ্রসৈকতসহ ৬৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা কউকের অধিক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়। কার্যত এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব মানছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা না মেনে কমপক্ষে ১৫টি স্থাপনা নির্মিত হয়েছে সৈকতকে কেন্দ্র করে। আইন ভঙ্গের এ খেলায় পিছিয়ে নেই সরকারি সংস্থাও।

এ বিষয়ে কউকের চেয়ারম্যান কমোডর (অব.) মোহাম্মদ নূরুল আবছার বলেন, ‘আইন অনুযায়ী বিচ ম্যানেজমেন্ট কউকের হাতে থাকার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি; সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। এখন দেখা যাক কী হয়।’ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কারা করছে আপনারা সবাই জানেন। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।’

জানা যায়, কক্সবাজার সৈকত ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০২ সালে একটি কমিটি গঠন করে দেয় পর্যটন মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিই এখন পর্যন্ত সৈকতের দেখভাল করছে। ২০১৬ সালে কউক প্রতিষ্ঠার পর আইন অনুযায়ী সংস্থাটির হাতে সৈকতের দায়িত্ব বর্তালেও কউক এখানে অনেকটা নিষ্ক্রিয়।

এ নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কউক চেয়ারম্যানের চিঠিতে বলা হয়েছে, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্রের গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির হাতে থাকায় সৈকত ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনে দ্বৈততা সৃষ্টি হচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। এর ফলে সমুদ্রসৈকতে অবৈধ স্থাপনা ও দখল উচ্ছেদ, সি-বিচের সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘২০০২ সালের প্রজ্ঞাপনের বলেই জেলা প্রশাসক বিচ ম্যানেজমেন্ট করে থাকেন। এখন সরকার যদি এ চিঠি বাতিল করে কাউকে ক্ষমতা দেয়, তাহলে দেবে। আমি এখনো কোনো চিঠি পাইনি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কক্সবাজার এলাকায় ইমারত নির্মাণের জন্য এত দিন বিশেষায়িত কোনো সংস্থা ছিল না। এ কারণে সেখানে অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে কউক গঠনের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন (বিসি) কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এ কমিটির আওতাধীন এলাকার ভবন নির্মাণ, ভূমি উন্নয়ন, পাহাড় কাটা, সমুদ্রসৈকতের পাশে আবাসিক, বাণিজ্যিক হোটেল/ভবন অথবা পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আইনে থাকা বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা বা বিশেষ পর্যটন অঞ্চল নিয়েও এ কমিটি কাজ করছে। তবে সংস্থাটির বোর্ড সভায় নির্ধারিত সব কর্মকর্তা উপস্থিত হন না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সমুদ্রসৈকতের সীমানায় কিছু স্থাপনা করা হয়েছে, যা সব কটি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। আবার উচ্চ আদালতের রায়ে যেসব এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে, সেখানেও কয়েকটি হোটেল নির্মিত হয়েছে। আরও কিছু হোটেল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আবার বিচের পাড়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে বড় বড় বিলবোর্ড। এ ক্ষেত্রে অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছে কউক।

জানতে চাইলে কউকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা এসব স্থাপনার মালিকদের চিঠি দিয়েছি, আর কিছু উচ্ছেদ করছি। বড় বড় স্থাপনায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, বিচ ব্যবস্থাপনা কাজে অনেক টেকনিক্যাল বিষয় জড়িত। তাই সেখানে কারিগরি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্বে থাকা উচিত। কারণ, বিচ এলাকায় ভূমির ব্যবহার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ-সংক্রান্ত কাজ জেলা প্রশাসন করতে পারবে না। তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বিচের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের কাছে এলে সুফল পাওয়া যাবে।

সূত্র: আজকের পত্রিকা