কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের লেনদেন প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলায় নগদ অর্থের লেনদেন ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) নগদ অর্থের লেনদেন প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়,কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকা বা এর বেশি নগদ জমা অথবা উত্তোলন হলে সেটিকে চিহ্নিত করা হয় ক্যাশ ট্রানজেকশন (সিটিআর) বা নগদ লেনদেন হিসেবে। ব্যাংকগুলোর বিএফআইইউতে এ ধরনের লেনদেনের তথ্য জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও অপরাধ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় টুল বা মাধ্যম হলো সিটিআর।

বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী,কক্সবাজারসহ দেশের সীমান্তবর্তী ২১ জেলায় গত দুই অর্থবছরে মোট নগদ লেনদেন হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা,যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা।

সে অনুযায়ী গত অর্থবছরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ অর্থের লেনদেন বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলায় নগদ অর্থের লেনদেন হয়েছে ১৪ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।

এসব জেলায় নগদ লেনদেন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধকে দায়ী করছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। এর কারণে জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। সীমান্ত এলাকাগুলো এখন মাদক স্বর্ণ,মানবপাচার ও পশু চোরাচালানেরচোরাচালানের মতো অপরাধগুলোর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

এ কারণে এসব এলাকায় অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁকিও বেশি। সীমান্ত এলাকায় বড় অংকের লেনদেন এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর তুলনামূলক একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে বিএফআইইউ।

বিএফআইইউর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও। তাদের ভাষ্যমতে, সীমান্তে মাদক,স্বর্ণ, পশু ও মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো আগেও অনেক বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। এখন এর পাশাপাশি চোরাচালানের মতো অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের ব্যাপ্তিও এখন বাড়ছে।

বিশেষ করে ডলার সংকট দেখা দেয়ার পর থেকে মুদ্রাটিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় কেউ কেউ ঝুঁকে পড়ছেন অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের দিকে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ।

মিয়ানমারের সীমান্ত সংলঘ্ন কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, চকরিয়া, নাইক্ষংছড়ি,লামা ও আলিকদম ইয়াবা,আইস,স্বর্ণ,মানবপাচার ও পশু চোরাচালানের বড় রুট হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে প্রতি বছর মাদক উদ্ধার হয়েছে সবচেয়ে বেশি টেকনাফ,উখিয়া ও নাইক্ষংছড়িতে। যেহেতু এখানেই সবচেয়ে বেশি উদ্ধার হয়েছে তার মানে জেলাটিতে মাদক পাচার ও চোরাচালানের বড় রুট রয়েছে। আর মানব পাচারের বিষয়টিও টেকনাফ ও উখিয়ায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বজায় রয়েছে।

সমুদ্রের কিছু অংশ বাদ দিলে কক্সবাজার জেলার স্থল সীমান্তের অনেকাংশই ঘিরে রয়েছে মিয়ানমার । সীমান্তরক্ষীসহ দেশের নিরাপত্তা খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ এ সীমান্তের বড় একটি অংশ হয় দুর্গম অথবা সাগর দিয়ে চিহ্নিত। সীমান্তরক্ষীদের পক্ষে এ ধরনের এলাকায় সার্বক্ষণিক টহল চালানো প্রায় অসম্ভব। কাঁটাতারের বেড়াও নেই। এর সুবাদে সীমান্তের এপার-ওপারে পাচার হয়ে যাচ্ছে ইয়াবা,আইস,স্বর্ণ ও পশু সহ চোরাচালানের নানা ধরনের পণ্য।

বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আর্থিক অপরাধ চিহ্নিত ও তা প্রতিরোধ করতে তত্পরতা বাড়ানো হয়েছে। যেমন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এ ধরনের তত্পরতা চালাতে যেকোনো একটি ব্যাংকের শাখাকে লিড ব্যাংক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এরপর ওই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় স্থানীয় ব্যাংকের শাখাগুলোকে নিয়ে সীমান্তকেন্দ্রিক আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধে সভা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

২০২২ সালেও ১৩টি সীমান্তবর্তী জেলায় এ ধরনের কার্যক্রম চালানো হয়। সামনের দিনগুলোতেও এ ধরনের কার্যক্রম চালু থাকবে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও নিয়মিতভাবে সীমান্তকেন্দ্রিক সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য দিচ্ছে বিএফআইইউ।’