কক্সবাজারে হাজী বিরিয়ানির নামে প্রতারণা

শাহীন মাহমুদ রাসেল ◑

পর্যটকদের অন্যতম বিনোদনের স্থান কক্সবাজারে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে নকল হাজী বিরিয়ানি’র স্টল। তাতে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে ক্রেতারা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হাজীর বিরিয়ানির নাম ভাঙ্গিয়ে গড়ে ওঠা এসব বিরিয়ানি স্টলে খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয় নিম্নমানের উপাদান। ফ্রিজে সংরক্ষিত মাংস রান্না, পোড়া তেলের ব্যবহার, পরিমাণে কম দেওয়া এবং ক্যামিকেল মিশ্রণের অভিযোগও রয়েছে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের বাজারঘাটার পুরাতন গাড়ির মাঠ এলাকায় ও কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের বিভিন্ন স্থানে আকর্ষণীয় সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন কতেক অসাধু ব্যবসায়ী। অল্প কয়েকগজের ব্যবধানে রয়েছে বেশ কয়েকটি নকল হাজী বিরিয়ানির স্টল। ‘নিউ হাজী বিরিয়ানি হাউজ’ নামে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে অভিনব পদ্ধতির প্রতারণা।

স্থানীয় জনসাধারণ, দর্শনার্থী ক্রেতারা আসল হাজী নান্না বিরিয়ানির স্বাদ দেখতে ’ঢু’ মারেন নকল করা নামের এই মিনি রেস্তোরাঁয়। বিরিয়ানির স্বাদ নেয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুরতো দূরে থাক খাবারের পয়সা উসুল হলো কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে বসেন অনেকেই। এইসব অসাধু ব্যবসায়ীরা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ক্রেতাদের প্রতারিত করে আসছেন অহরহ। ক্রেতারা না বুঝেই নাম নকল করা হাজির নান্না বিরিয়ানি স্বাদ নিতে রেস্তোয়াঁয় ঢুকে নিন্মমানের খাবার খেয়ে প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এতে করে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো সম্পর্কে তাদের মনে বিরূপ ধারণাও তৈরি হচ্ছে। কলাতলীতে হাজী বিরিয়ানি নামের যে রেস্তোরাঁটি আছে সেটা কিন্তু আসল হাজীর নান্না বিরিয়ানি নয়।

কাকডাকা ভোরে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে বিরিয়ানি বিক্রি। কম খরচে বেশি লাভের উদ্দেশ্য হওয়ায় স্বাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে খাবারের গুণগত মান বজায় রাখায় ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের। দিনের পর দিন একই তেল ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় ফেলে একই জলে বারবার বাসনপত্র ধোয়া হয়। খাবার তৈরির সময়েও অপরিশোধিত পানি ব্যবহার করা হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

কক্সবাজারে হাজী বিরিয়ানী খেয়ে ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা আরমান নামের এক ভদ্রলোক জানান, ব্যবসা বাড়ানোর জন্য মালিক হাজী বিরিয়ানির নাম দিয়েছে। এটা আসল হাজী বিরিয়ানি নয়। পুরান ঢাকার আসল হাজী বিরিয়ানি কেমন, তা দূর থেকে গন্ধ শুকেই বলে দেয়া যায় এটা ঐতিহ্যবাহী হাজীর নান্না বিরিয়ানি। কক্সবাজারে হাজী বিরিয়ানি বলে যেটা বিক্রি হচ্ছে তার না আছে সেই ঘ্রাণ, না আছে সেই স্বাদ। এখানে শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করে সুগন্ধযুক্ত কেমিক্যাল খেয়ে স্বাস্থ্যে রোগবালাই সৃষ্ঠি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি এসব মানহীন খাবারের মূল্য হিসেবে প্রতি প্লেট মোরগ-পোলাও ১১০ টাকা, গরুর তেহারী ও খাসির কাচ্ছি ১২০ টাকা নেয়া হয়। দাম অনুযায়ী মানসম্মত খাবার পাচ্ছে না ক্রেতাসাধারণ। ব্যস্ততম সড়কের পাশে অবস্থিত স্টলের উম্মুক্ত পাতিলের খাবারের সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে উড়ে আসা ধুলোবালি। খোলা হাতে পরিবেশন করা হচ্ছে খাবার। প্রত্যেকটি স্টলে আছে একাধিক শিশুশ্রমিক। স্টলের অভ্যন্তরীণ পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর।

আসল না নকল এ বিষয়ে দোকান মালিকদের প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, আসল হাজী বিরিয়ানী এখানে আমরা অনুমতি ছাড়া তৈরী করতে পারবোনা। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী সেই বিরিয়ানীর স্বাদতো যেভাবেই হোক দিচ্ছি। সুগন্ধযুক্ত কেমিক্যাল আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে চলে যান।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার সদর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউর রহমান বলেন, মানহীন খাবার পরিবেশন শুধু ভোক্তা অধিকার নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও সামিল। তাছাড়া প্রশাসনের নাকের ডগায় ভেজাল মিশ্রিত খাবার বিক্রি আমাদের কাম্য নয়। এ বিষয়ে আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

উলে­খ্য, পুরান ঢাকার মানুষের হাজারো খাবার তালিকায় নিঃসন্দেহে বিরিয়ানি প্রথম সারিতেই রয়েছে। পুরান ঢাকার খাবার তালিকায় বিরিয়ানি হওয়ার অনেক কারণও রয়েছে। মোগল আমল থেকে ঐতিহ্যগতভাবেই এ এলাকার মানুষের খাবার-দাবারে ছিল বেশ নবাবি সংস্কৃতি। সেই ঐতিহ্য পুরান ঢাকাবাসী আজও ধরে রেখেছে।

আর এই খাবার সরবরাহে বেশকিছু জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে হাজী বিরিয়ানি অন্যতম। কারণ হাজী মোহাম্মদ হোসেনের বিরিয়ানি নামটার খুব একটা প্রচলন নেই, এর প্রচলিত নাম হচ্ছে হাজী বিরিয়ানি। ঢাকার বংশাল থানাধীন নাজিরা বাজারের ৭০ কাজী আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত হাজি বিরিয়ানির কথা।

১৯৩৯ সাল থেকে এই বিরিয়ানির যাত্রা শুরু এবং এখনো চলছে গৌরবের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে। বংশপরম্পপনায় এই ব্যবসায় দীর্ঘদিন ধরে রেখেছেন হাজী মো. হোসেনের পরিবারের লোকজন। মরহুম হাজি মোহাম্মদ হোসেনের মৃত্যুর পর এই ব্যবসার হাল ধরেন তারই পুত্র হাজি গোলাম হোসেন।

২০০৬ সালে হাজী গোলাম হোসেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র হাজী মো. শাহেদ হোসেন এই ব্যবসার হাল ধরেন। এখন এই ব্যবসা দেখাশোনা করেন হাজী মোহাম্মদ বাপী যিনি মরহুম হাজী মো. হোসেনের নাতি হন সম্পর্কে।