টেকনাফের ইয়াবা গডফাদারদের বিনা বিচারে ‘আত্মসমর্পণ’ খবরে অখুশি সাধারণ মানুষ

দীপক শর্মা দীপু :‍‍

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণের খবর নিয়ে কক্সবাজারে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই খবরে ইয়াবা গডফাদাররা খুশি হলেও সাধারণ মানুষ অখুশি। তারা চাই জাতি ধ্বংসকারি ইয়াবা কারবারিদের উপযুক্ত শাস্তি। আর ইতিমধ্যে বন্দুক যুদ্ধে নিহতদের পরিবারের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যারা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে তাদের এই সুযোগকে না দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে কেন ?

চুনোপুটিদের মরার পর এখন যখন ইয়াবা গডফাদারদের পালা তখন আওয়াজ উঠছে আত্মসমপর্ণের কথা। চুনোপুটিদের যারা ব্যবহার করেছেন তারা তাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। এখন নিজেরা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষনার পর গত মে মাস হতে দেশব্যাপী একযোগে মাদক বিরোধী সাঁড়াশী অভিযান শুরু করে আইনশৃংখলা বাহিনী। এতে সারাদেশে এ পর্যন্ত চারশর বেশী লোক মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টটার অভিযোগে আইন শৃংখলা বাহিনী অথবা নিজেদের মধ্যে বন্দুরযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ইয়াবার প্রবেশদ্বার হিসাবে খ্যাত টেকনাফেও শুধু হয় মাদক বিরোধী এ বিশেষ অভিযান। শুরুতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এ অভিযানকে তেমন একটা পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে একের পর এক মাদক ব্যবসায়ীর গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটতে থাকলে নড়েচড়ে বসে সীমান্তের শীর্ষ ইয়াবা কারবারীরা। এরপর চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা গা ঢাকা দিতে শুরু করে। খা খা করতে থাকে তাদের সুরম্য ইয়াবা প্রাসাদ গুলো। একপর্যায়ে গত অক্টোবর মাসে প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন। এরপর অভিযানের তীব্রতা বেড়ে যায় বহুগুনে। বাড়তে থাকে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা।

টেকনাফে এপর্যন্ত আইনশৃংখলা বাহিনী ও নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ৩৫জনের বেশী মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। তারমধ্যে গত দুইমাসে ওসি প্রদীপের যোগদানের পর ২০ জনের বেশী নিহত মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। শুধু বন্দুকযুদ্ধই নয় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সুরম্য অট্টালিকা গুলোও ভেঙ্গে দিতে থাকে প্রশাসন।

নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তালিকাভুক্ত ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। অভিযানের তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। একদিকে বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক প্রানহানি, অপরদিকে সুরম্য ইয়াবা প্রাসাদগুলো ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে বুলডোজারের আঘাতে। এ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে থাকে তারা। আত্মসমর্পনের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে দফায় দফায় গোপন বৈঠক বসে শীর্ষ ইয়াবা গডফাদাররা।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত তৈরী করে সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা গেলে হয়তো আত্মসমর্পন করে অভিযান থেকে বেঁচে যেতে পারবে তারা। ইতিমধ্যে সেভাবেই প্রস্তুতি গ্রহন আত্মসমর্পনের তালিকা প্রস্তুত করে তারা। আর এর খরচ যোগাতে আত্মসমর্পনে ইচ্ছুক ইয়াবা কারবারীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত আদায় করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই এগুচ্ছিল।

সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় ও সামাজিক গণমাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্ণের মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়ার খবর প্রচার শুরু হয়েছে। আত্মসমপর্ণ করে বাঁচার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এসব নানা আলোচনা সমালোচনায় তোলপাড় হয়ে উঠেছে কক্সবাজার।

এর মধ্যে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ইয়াবা ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষকে জড়ো করে সকল ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণ করার আহবান জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় শীর্ষে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ী ১০ম জাতীয় সংসদের সদস্য আবদুর রহমান বদি।

আবদুর রহমান বদি বলেন,“ তোমরা যারা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত আছ, যারা তালিকাভুক্ত বা তালিকাভুক্তের বাইরে আছ তোমরা আত্মসমপর্ণ করো। আগামি ৫ দিনের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আমার সাথে যোগাযোগ কর। আমি আত্মসমপর্ণ করিয়ে দেব। যা করেছো করেছো, আর করবেনা। এসো সবাই মিলেমিশে তোয়াবা করে টেকনাফের মধ্যে এটা প্রমান করবো আমরা ইয়াবামুক্ত হয়েছি।”
এদিকে আবদুর রহমান বদির এমন বক্তব্যের পর নানা আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। সচেতন মহলে আত্মসমর্পন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এনিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে। টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক গুরা মিয়া গত বুধবার তার ফেইসবুকে টাইমলাইনে লিখেছেন :“ জলদস্যূ আর ইয়াবা বিয়ারি এক না।টেকনাফে কিছু সংবাদ কর্মি ইদানিং ইয়াবা বিয়ারির পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করছে।

যা প্রধান মন্ত্রী ঘোষিত মাদকের জিরু টলারেন্স নীতির সাথে অনেকটা সাংঘর্ষিক। তাদের যুক্তি হচ্ছে জলদস্যূরা যদি ক্ষমা পায় মাদক বিয়ারিরা কেন পাবে না? জলদস্যূরা দস্যূমি করে হয়তো গুটি কয়েক জন কে হত্যা করছে কিংবা কিছু টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে সংসার চালিয়েছে। ইয়াবা বিয়ারিরা সমাজ সহ পুরা জাতিকে ধ্বংস করেছে এবং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে গেছে।

অহরহ মানূষের ভূমি জবর দখল করেছে।অগনিত সাধারণ মানূষ কে অহেতুক হয়রানি করেছে। সমাজের সম্মানিত ব্যাক্তিদের কে অপমানিত করেছে। কথায় কথায় গুলি চালিয়েছে। এ সবের ক্ষতিপূরণ বহন করবে কে? তা ছাড়া ইতি পূর্বে যারা ক্রসফায়ারের স্বীকার হয়েছে তারাওতোত একই অপরাধে অপরাধী।

অনেকে আছে আবার মিথ্যা মামলার আসামি। তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্তইবা আসতে পারে? সব মিলিয়ে একটা অজানা গল্প রচনা না করায় ভাল। হাজার ও সমস্যা হইতে পারে।(মনে রাখতে হবে অপরাধ করলে ফল ভোগ করতে হবে)”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আবদুর রহমান বদির নাম। গত দুই মেয়াদের এই সাংসদের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারিদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইয়াবা পাচারের ‘হোতা’ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় নাম রয়েছিল তার। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে বদির এক বেয়াইও ছিলেন। ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় তিনিসহ তার পরিবার ও নিকট আত্মীয়ের ২৫ জনের নাম রয়েছে।

এসব কারণে সমালোচিত বদি এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, তার স্ত্রী শাহিন আকতার চৌধুরী নৌকার প্রার্থী হিসেবে কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ-উখিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

এদিকে তালিকায় শীর্ষে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বদি সবাইকে আত্মসমপর্ণের কথা বলেছেন। কিন্তু তাকে কে আত্মসমপর্ণ করাবে এই প্রশ্ন তুলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর জানান, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে সবাই এই সুযোগকে পূঁজি করে সবাই ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়বে। পরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে।

টেকনাফের বহুল আলোচিত সমালোচিত র‌্যাবের গুলিতে নিহত কমিশনার একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, ইয়াবায় জড়িত না থেকেও বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে প্রাণ দিত হলো র‌্যাবের হাতে। আর এখন যারা প্রকৃত ইয়াবা কারবারি তাদের আত্মসমপর্ণের নামে বাঁচিয়ে দেয়া যদি হয়, তাহলে এটা কেমন বিচার হবে ? যদি তাই হয় তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারনে যারা আমার স্বামীকে হত্যার করতে ষড়যন্ত্র করেছে তারা এখন আত্মসমপর্ণের নামে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো: আলী জানান, মুলত যারা ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। তালিকায় থাকলে এটা প্রমান করে না যে , তারা সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী। অপরাধ না করে তালিকায় থাকলে তাদেরকে আত্মসমপর্ণ করতে হবে ্এটা মানে হতে পারেনা। তালিকায় থাকুক বা না থাকুক যারা আসলে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, কোন অপরাধী অপরাধ স্বীকার করে আত্মসমপর্ণ করতে চাইলে তা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে। এমপি আবদুর রহমান বদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে হয়তো নিজ তাগিদে সবাইকে আত্মসমপর্ণ হওয়ার জন্য বলেছেন। এখনো পর্যন্ত ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। জলদস্যুরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমপর্ণ করেছে।

ইয়াবা কারবারিরা কিভাবে করবে তা ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণের ব্যাপারে কঠিন শর্ত দেয়া হতে পারে। শর্তবিহীন আত্মসমপর্ণ করে অপরাধ থেকে রেহাই পাবার কারও সুযোগ নেই।