দালালের হাত ধরে ভারত থেকে আসছে রোহিঙ্গারা

৩ সদস্যের পরিবারের জন্য ২০ হাজার টাকা
• ৫ সদস্যের পরিবারের জন্য ৪০ হাজার টাকা 
• বেশি সদস্যের পরিবারের জন্য ৭০ হাজার টাকা

অনলাইন ডেস্ক :গত বছরের অক্টোবরে ভারত অন্তত সাত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় দিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর আর হায়দরাবাদে আশ্রয় নেওয়া অন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে জোর করে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষাপটে গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ভারত থেকে আসা বেশ কিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে গত কয়েক দিন কথা বলে জানা গেছে, একশ্রেণির দালালের সহায়তায় ভারত থেকে পালিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন।

ভারত থেকে আসা এসব রোহিঙ্গার দাবি, ৩ সদস্যের পরিবারের জন্য ২০ হাজার টাকা, ৫ সদস্যের পরিবারের জন্য ৪০ হাজার ও ছয়ের বেশি সদস্যের পরিবারের জন্য ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে দালালেরা। পাশাপাশি সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকাপয়সা, মুঠোফোন ও কাপড়চোপড়। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছয় রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

ভারতের নয়াদিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দরাবাদের বিভিন্ন শিবিরে অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে।

নয়াদিল্লির জাফরাবাদ থেকে পালিয়ে আসা ছয় রোহিঙ্গা নারী ছুরা খাতুন, হোসনে আরা, হাসিনা বেগম, ইয়াসমিন আক্তার, তসমিন আরা, মিনারা আক্তারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। টেকনাফের নয়াপাড়ার জাদিমোরা শালবন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গা নারী জানান, তাঁদের পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য পালিয়ে আসতে পারেননি। ভারতীয় দালালদের হাতে রয়েছেন।

এদিকে ভারত থেকে আসা প্রায় ১ হাজার ৪০০ রোহিঙ্গার অধিকাংশের আশ্রয় হয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরে। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ফিরাস আল খাতিব বিবিসিকে বলেন, ‘গত বছরের মে-জুন মাস থেকেই কিছু কিছু করে রোহিঙ্গা আসতে শুরু করে। তবে জানুয়ারিতে সংখ্যাটি অনেক বেড়েছে। নিয়মিত শিবিরগুলোতে তাদের একটি ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আপাতত ইউএনএইচসিআরের অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরে রাখা হয়েছে এবং তাদের সব রকম সহায়তাই দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের ইচ্ছাতেই ভারত থেকে তারা বাংলাদেশে এসেছে বলে আমাদের জানিয়েছে, কিন্তু কেন এসেছে, সেটা জানতে আরেকটু সময় লাগবে।’ 

পালিয়ে আসা নারীদের বর্ণনায়

নয়াপাড়ার জাদিমোরা শালবন রোহিঙ্গা ডি-৩ ব্লকের একটি ঝুপড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে দেড় বছর বয়সের এক শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন মা তসমিন আরা (২০)। তসমিন জানান, ভারতীয় এক দালালের সঙ্গে তাঁদের ২০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। দালালেরা টাকা নেওয়ার পর নারী-শিশুদের এক দলে ও পুরুষদের আরেক দলে ভাগ করে। তসমিনসহ ২০ নারী একটি দলে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁরা এই ছয়জন ছিলেন মিয়ানমারের মংডু শহরের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। দালালেরা প্রথমে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে তাঁদের ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করে। পরে তাঁরা সে দেশের পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। শেষে হিলি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন।

তসমিন বলেন, শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে আসতে পারলেও স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।

এই দলের আরেক নারী হাসিনা বেগম। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পারলেও স্বামী মো. হাসানের খোঁজ নেই। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসার সময় ভারতীয় দালালের লোকজন আমাদের সঙ্গে থাকা নগদ টাকা, কাপড়চোপড় ও মুঠোফোন কেড়ে নেয়। বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পর অনেকে টাকাপয়সা দিয়ে টেকনাফে আসার ব্যবস্থা করে। ভারত থেকে টেকনাফে আসতে ৯ দিন সময় লেগেছে বলে জানান তিনি।

ছুরা খাতুন (৫০) বলেন, ‘স্বামী ছাড়া এখানে অনেক কষ্টে আছি। ঠিকমতো সন্তানদের মুখে খাবার দিতে পারছি না। শীতের কাপড় না থাকায় খুবই কষ্টে জীবন যাপন করছি।’

এই ছুরা খাতুন প্রায় ১২ বছর আগে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢোকেন। এরপর আবার দালালের সহায়তায় ভারতে যান। এখন আবার পালিয়ে এলেন বাংলাদেশে। ছুরা খাতুনের ভাষায়, ‘এভাবে চলছে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তু জীবন।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও নয়াদিল্লিতে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় ধরপাকড় চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ভয় কাজ করছে। এরই মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ রোহিঙ্গা ভারত থেকে পালিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।