পুলিশ সম্পর্কে কী কী জানি

জামাল উদ্দিন, বাংলা ট্রিবিউন •

দেশের ভেতর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার মূল দায়িত্ব পুলিশের ওপর। স্বাধীনতার পর আকারে ও কাজের ধরনে প্রসার বেড়েছে পুলিশের। রাজধানী, মহানগর, জেলা শহর বা প্রত্যন্ত গ্রামে সবখানে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা। অপরাধ দমনে নানা কৌশলে কাজ করছে এই বাহিনী। জনগণের সেবায় তারা যেমন নিবেদিত রয়েছে, পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নানা অভিযোগও রয়েছে। সবকিছুর ওপরে জনমনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য পুলিশের কোনও বিকল্প নেই বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশ কবে প্রতিষ্ঠিত

দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ অ্যাক্টের ৫ নম্বর ধারার অধীনে ১৮৬১ সালে পুলিশ বিভাগ গঠন করে তখনকার ব্রিটিশ সরকার। এরপর থেকে ‘পুলিশ আইন ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-১৯৪৩’-এর বিধি-বিধান অনুযায়ী বর্তমান পুলিশ বিভাগ পরিচালিত হয়। মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স জারি করে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৭৮ সালে শুরু হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কার্যক্রম। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যক্রম চালু করা হয়। বর্তমানে দেশে ৮টি মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ময়মনসিংহ মেট্রোপলিটন পুলিশের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন আছে।

পুলিশের যত ইউনিট

জননিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় বর্তমানে পুলিশের অনেক ইউনিট কাজ করছে দেশে। এরমধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজ, ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস), পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার (পিটিসি), ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), স্পেশাল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন), নৌ পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ রিজিয়ন, শিল্পাঞ্চল পুলিশ, পুলিশ টেলিকম, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), রেঞ্জ পুলিশ, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ), ট্যুরিস্ট পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

এছাড়া পুলিশের সোয়াত টিম, বোম ডিসপোজাল ইউনিট, তদন্ত কেন্দ্র, ক্যাম্প, ফাঁড়ি, সার্কেল, বিট পুলিশ এবং সাইবার পুলিশসহ পুলিশের ছোট ছোট আরও অনেক ইউনিট ও শাখা রয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরেই রয়েছে অনেক সেকশন ও ইউনিট। উল্লেখযোগ্য শাখা ও ইউনিটগুলোর মধ্যে ইন্টারপোল ও জাতিসংঘ মিশন বিষয়ে কাজ করে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। এছাড়া আইন শাখা, গোপনীয় শাখা, ল-ফুল ইন্টারসেপশন সেল, পারসোনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ল্যান্ড অ্যান্ড স্টেট শাখাসহ অনেক শাখা রয়েছে।

পুলিশের আরও বেশ কয়েকটি ইউনিট ও বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট গঠনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া এয়ার উইং নামে পুলিশের আরেকটি ইউনিট গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এতে থাকবে দক্ষ জনবল ও দুটি হেলিকপ্টার।

কার কী কাজ

সার্বিকভাবে পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তায় কাজ করলেও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ও শাখাগুলোর কাজ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন।

সাইবার ইউনিটের পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ দমনে। পর্যটন শিল্পের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ, শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ দমন, মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব নিরসনসহ সার্বিক নিরাপত্তার জন্য শিল্প পুলিশ, নৌ পথের অপরাধ দমনে নৌ পুলিশ, সড়ক-মহাসড়কে অপরাধ দমনে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে।

থানা পুলিশ সাধারণ মানুষের সব ধরনের সেবার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সিআইডি ও পিবিআই শুধু মামলার তদন্ত কাজ করে থাকে। তবে সিআইডির কাজের পরিধি এখন অনেক বেড়েছে। অর্থপাচার, মানি লন্ডারিং, সাইবার অপরাধসহ অনেক বিষয় নিয়ে পুলিশের এই সংস্থাটি কাজ করছে।

র‌্যাবের কাযক্রম কী—সেটা সাধারণ মানুষের এখন আর অজানা নেই। জঙ্গি, মাদক ও দাগী অপরাধী গ্রেফতারে তারা অন্যতম। বর্তমানে র‌্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) নামে বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হয়েছে।

সাইবার পুলিশ সেন্টার দেশের মধ্যে বিটিআরসি, এনটিএমসি, বিজিডি-গভ. সিআইআরটি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এনসিএমইসি, এনসিবি, ইন্টারপোল, এফবিআই, এএফপি কেওআইসিএ, ফেসবুক, ইউএনওডিসি ও টিকটকের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে।

পুলিশে জনবল

বর্তমানে পুলিশে দুই লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪ জন সদস্য কর্মরত আছেন। এরমধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি ২২ জন, ডিআইজি ৮৫ জন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি ২০০ জন, পুলিশ সুপার (এসপি) ৫৯৩ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল এসপি) ১০০১ জন ও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ১২২২ জন। ক্যাডার পদে সর্বমোট তিন হাজার ১২৪ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। ইন্সপেক্টর ৬ হাজার ৮৯৮ জন, এসআই ২৪ হাজার ৪২৯ জন এবং কনস্টেবল আছেন এক লাখ ২৯ হাজার ৯১২ জন। বর্তমানে প্রায় ৮০০ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।

সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা

পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, মাঠ পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে তাদের সমস্যার অন্ত নেই। অতিরিক্ত ও দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন, ছুটি না পাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক ও যানবাহন সংকট, শৌচাগার সমস্যা, আবাসন সংকটসহ অসংখ্য সমস্যার মধ্য দিয়েই তাদের দায়িত্বগুলো পালন করে যেতে হয়। রাস্তায় কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের আইন না মানার প্রবণতা নিরসনেও তাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে গিয়েও তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হলে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়, অপরদিকে দমনে কঠোর হলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।

কর্মকর্তারা যা বলছেন

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘পুলিশের নানমুখী সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এসব পুরানো বিষয়। এগুলো মোকাবিলা করেই কাজ করে যেতে হবে। তবে পুলিশের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলোর সমাধান আগে করা জরুরি। তাহলে তাদের কাজের গতি থাকবে।’

সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া সম্প্রতি তার এক লেখায় বলেছেন, পুলিশ বিভাগকে আরও দক্ষ ও চৌকস হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে দেশের ৩০ জেলায় ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার চালু করা হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত চারটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার— পুলিশ সদস্যদের দক্ষ ও সক্ষম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ২০০০ সালে ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পুলিশ স্টাফ কলেজে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুলিশ কর্মকর্তা আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। এছাড়া সিআইডির ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল (ডিটিএস), এসবি ট্রেনিং স্কুল, টিডিএসে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি, জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা এবং উন্নত দেশ থেকেও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা উন্নত ও আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পুলিশ দেশের জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশের উঁচুমানের দক্ষতা সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদার সদস্যরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন।