প্রাথমিকের শিক্ষকরা কর্মচারী, ইউপি সচিবরা হচ্ছেন কর্মকর্তা

রাহুল শর্মা •

আপনি যদি প্রাথমিকের শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন, তাহলে আপনি এই রাষ্ট্রের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অথচ একই ক্ষেত্রবিশেষে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যদি পুলিশে উপপরিদর্শক, হাসপাতালের নার্স, কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি পান, তাহলে আপনি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা।

শিক্ষার ভিত গড়ে দেন যারা, সরকারি মর্যাদাক্রমে তাদের অবস্থান বিভিন্ন দপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, হিসাব সহকারী, অডিটর, জুনিয়র অডিটর ইত্যাদি পদের সমান। এখন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের পদমর্যাদাও প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে বেশি করে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭১টি। প্রতিটি পরিষদে একজন করে সচিব আছে। এই সাড়ে চার হাজার মানুষের দাবির মুখে এই পদটি তৃতীয় শ্রেণি থেকে সরকার দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

গত ১৮ নভেম্বর এই প্রস্তাব করে মতামতের চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে।

প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিশুদের শিক্ষাজীবনের ভিত রচনা করেন। বিশ্বের সব উন্নত দেশেই এই শিক্ষকদের অত্যন্ত মর্যাদার আসনে রাখা হয়। কিন্তু আমরা তাদের তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছি। এতেই বোঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্র। আমি মনে করি, প্রাথমিকের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে।

প্রাথমিকের শিক্ষক সংখ্যা এর ৮০ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি। সব মিলিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অথচ শিক্ষকদের বিষয়টি বিবেচনাতেই আনছে না সরকার।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা ভীষণ হতাশ, বছরের পর বছর ধরে তাদের এই দুঃখের কথা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাতে কোনো সংস্থাই গা করছে না।

এমনকি শিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, সব জেনে বুঝেই শিক্ষক পদের জন্য তারা আবেদন করেন। এখন চাকরি পেয়ে এই দাবি তুললে সেটি হবে না।

পদের মর্যাদার পাশাপাশি বেতনেও আছে বৈষম্য। সরকারের সর্বশেষ বেতন কাঠামো অনুযায়ী ত্রয়োদশ গ্রেডে বেতন পান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।

এই স্কেল অনুযায়ী সব মিলিয়ে একজনের বেতন হয় ২৬ হাজার ৫৯০ টাকা।

একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বেশ কয়েকটি সরকারি চাকরিতে কর্মরতরা পান দশম গ্রেডের বেতন।

এই স্কেলে সব মিলিয়ে একজনের বেতন হয় ৩৮ হাজার ৬৪০ টাকা।

এ নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষোভ প্রাথমিকের শিক্ষকদের। মর্যাদার প্রশ্ন ছাড়াও আর্থিক দিক থেকে তারা কেন এই বৈষম্যের শিকার হবেন, এই প্রশ্ন তুলছেন তারা।

বেতন গ্রেড নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমরা যখন সরকারি চাকরিতে আবেদন করি তখন বেতন স্কেল দেখেই আবেদন করি। চাকরি পাওয়ার পর এখন আমরা বলছি যে আমি বঞ্চনার শিকার, সেটি মনে হয় সঠিক নয়।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিশুদের শিক্ষাজীবনের ভিত রচনা করেন। বিশ্বের সব উন্নত দেশেই এই শিক্ষকদের অত্যন্ত মর্যাদার আসনে রাখা হয়। কিন্তু আমরা তাদের তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছি। এতেই বোঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্র। আমি মনে করি, প্রাথমিকের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘তারা যে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দাবি করেছেন, সেটিই তো পর্যাপ্ত নয়। আমি মনে করি, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করা উচিত।’

২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড বা ধাপ রয়েছে। একজন চাকরিজীবীর বেতন থেকে শুরু করে অবস্থান, ক্ষমতা, দায়িত্ব ও অন্য সব সুযোগ-সুবিধা এই গ্রেডের সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রাথমিকে সর্বশেষ নিয়োগ হয়েছিল ২০১৮ সালে। সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের সর্বশেষ নিয়োগ যোগ্যতায় বলা হয়েছে কমপক্ষে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রিধারী হতে হবে। নিয়োগ পেলে তারা হবেন সরকারের ত্রয়োদশ গ্রেডের কর্মচারী।

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক দশম গ্রেড বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘একজন শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা পাবেন- এটা কখনই কাম্য হতে পারে না। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আশা করছি, সরকার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করবে।’

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি রাজেশ মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কিন্তু কেউ একে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে তো মনে হয় না। সরকার যদি শিক্ষকদের কর্মচারী করে রাখতে চায়, তাহলে এই পেশায় কেন উচ্চ শিক্ষিতরা আসবে? আর না এলে এটি শিক্ষার ক্ষতি বয়ে আনবে।’

তবে শিক্ষকদের এ দাবিকে যৌক্তিক মনে করেন না প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহাম্মদ মনসুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘বেতন গ্রেড নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমরা যখন সরকারি চাকরিতে আবেদন করি তখন বেতন স্কেল দেখেই আবেদন করি। চাকরি পাওয়ার পর এখন আমরা বলছি যে আমি বঞ্চনার শিকার, সেটি মনে হয় সঠিক নয়।’