বিশ্বনেতা হয়ে ওঠার গল্প

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো ও টানা তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, প্রভাবশালী, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ৫টি দেশের কোনটির প্রধানমন্ত্রী নন। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, একদা তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া দেশটার নেতৃত্ব দিতে দিতে তিনি নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়েছেন, বিশ্ববিখ্যাত প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায় তিনি এসেছেন।  বিশ্বের এই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন ৩ নম্বরে। এই তিন রাজনীতিবিদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করি তাহলে দেখতে পাব শেখ হাসিনার মত পাথর সময়, বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়নি প্রথম দুজনকে। প্রথম দুজনকে হারাতে হয়নি পুরো পরিবার; জীবন রক্ষায় আশ্রয় নিতে হয়নি ভিনদেশে; মোকাবেলা করতে হয়নি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তথা ১৯ বারের জীবন নাশের প্রচেষ্টা। তাদের নিশ্চিত করতে হয়নি পিতা হত্যার, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার। দমন করতে হয়নি জঙ্গিবাদ; মোকাবেলা করতে হয়নি ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, থেরেসা মে উন্নত পরিবেশে ধনীদের সমর্থন নিয়ে শুধু বুদ্ধি দিয়ে প্রতিযোগিতা করে হয়েছেন চ্যান্সেলর কিংবা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ হাসিনা যেখানে সবার থেকে এগিয়ে। শুধু ক্ষমতার পরিমাপ না করে ক্ষমতা অর্জনের পরিস্থিতি এবং প্রক্রিয়াটাও বিবেচনায় নিতেন তবে এঞ্জেলা মার্কেল নন, এক নম্বরে থাকতেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা কিভাবে বিশ্বব্যাপী এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন? সেই পর্যালোচনা করি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ছয় বছর তিনি প্রবাসে কাটিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে। ৮১ সালে যখন তিনি দেশে ফিরলেন তখন ৩০ লক্ষ শহীদ, ৪ লক্ষ বীরাঙ্গনার বাংলাদেশ স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত, পাকিস্তানের নতুন স্ট্রাইকার জেনারেল জিয়ার অধীনে। তখন পিতার খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে আইন পাশ হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বড় বড় রাষ্ট্রীয় পদে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে বাংলাদেশের কূটনীতিক। যুদ্ধাপরাধীরা নিয়ন্ত্রন করছে রাজনীতি। স্বাধীনতা বিরোধী সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা দেশে ফিরে বসে গেছেন উপরের পদগুলোতে। সেনাবাহিনীতে থাকা শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা। জয় বাংলা আর শেখ মুজিব তখন নিষিদ্ধ।

৮১ সালে দেশে ফিরে তো নিজের বাড়ির অধিকারটা পেলেন না। পারলেন না ৩২ নম্বরে গিয়ে প্রিয়জনদের জন্য প্রার্থনা করতে। এসবের মধ্যে ৮২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শেখ হাসিনা প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। দেশের মানুষ আবার এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। রাজপথ হয়ে উঠল তার ঘরবাড়ি; দেশের মানুষ তাঁর ভাইবোন, পরিজন। এদের নিয়েই এগিয়ে চলল তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম; গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবার সংগ্রাম। দেশের মানুষ তাঁকে বলল, ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’। 

শেখ হাসিনা যখন ৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি; দারিদ্র তালিকায় ৩/৪ নম্বরে। সুদান, ইথিওপিয়ার কাছাকাছি। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ৯৮ সালের বন্যা মোকাবেলা করে মাত্র দুই/চার বছরের মধ্যে তিনি দেশকে খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ করে তোলেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময়কালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি হারের গড় দাঁড়ায় ৫.২০% যা তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের সময় ছিল ৪.৩২%। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দারিদ্র হ্রাস হয়েছে তার প্রথম পাঁচ বছরে।

২০০৮ সালে ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে এবং তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করে রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে দেয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। এরপরে আসে বহু বাধা। কিন্তু তার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখেন। 

গত বছর আগস্টের শেষ দিকে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা শুরু হলে বাংলাদেশে নামে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল। শেখ হাসিনা বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাবার জোগাড় করতে পারলে আমরা আরও ১২ লক্ষ লোকের আহার সংগ্রহ করতে পারব; প্রয়োজনে হলে খাবার ভাগ করে খাব; এই নির্যাতিত মানুষদের আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। তাঁর এই পদক্ষেপে সারাবিশ্ব বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া, চ্যানেল ফোর তাঁকে খেতাব দেয়, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। দুবাইর প্রভাবশালী দৈনিক খালিজ টাইমস বলে, ‘পূর্বের নতুন সূর্য’। দিল্লিতে বিজেপির দেওয়া সংবর্ধনায় বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা এল কে আদভানী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলেন, ‘শেখ হাসিনাই বর্তমান সাউথ এশিয়ার মূল নেতা’।

শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আরও পরিচয় পাওয়া যায় নিউ ইয়র্কে। ১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢল আসার কয়েক দিন পর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে সেখানে সাংবাদিকেরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ে কথা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে কথা বলে কী করব, আমরাতো তাঁর শরণার্থী নীতি সম্পর্কে জানি’। এ কথা বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ঘোষণা আসে, রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে আমেরিকা। শেখ হাসিনার জন্য বহু সম্মান, স্বীকৃতি এসেছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ থেকে। বিভিন্ন ইস্যুতে পরামর্শ দেবার জন্য কয়েকবার আমন্ত্রণ পেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাত দেশের সংগঠন জি৭ সম্মেলনে যোগ দেবার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখায়, এ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দেয়ায় জাতিসংঘ তাঁকে খেতাব দিয়েছে, ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্যা আর্থ’। শেখ হাসিনার নারী উন্নয়ন নীতির ফলাফল স্বরূপ সমাজের সকল পর্যায়ে নারীর অংশ গ্রহণ, নেতৃত্বদান বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁকে জাতিসংঘের ইউএনওমেন ‘এজেন্ট অফ চেঞ্জ’ পুরস্কার প্রদান করে।

দেশীয় রাজনীতিতে তাঁর বিরোধীরাও আজ স্বীকার করে তাঁর অনন্য নেতৃত্বের গুণাবলী। তার সঙ্গে কারো তুলনা নেই। দলের সঙ্গে দলের তুলনা হতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা সবচেয়ে জনপ্রিয় তা তার বিরোধীরাও মানে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ছিটমহল চুক্তি, দুইটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোন রকম বিবাদ সৃষ্টি না করে সমুদ্র সীমার অধিকার আদায় করে নেয়া এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্রয় দেবার জন্য অচিরে তাঁকে বিশ্ব নেতা হিসেবে, শান্তির দূত হিসেবে স্বীকার করে নেবে টাইমস ম্যাগাজিন, নোবেল কমিটি। তাতে হয়তো খুব বেশিদিন দরকারও হবে না। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এখন অপেক্ষা শেখ হাসিনার নতুন কোন ম্যাজিকের জন্য।