মিয়ানমারে সু চি-মিলিটারি দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ার আভাস

ডেস্ক রিপোর্ট : মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের শীর্ষ নেতা অং সান সু চির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ার আভাস দিয়েছে কূটনীতি বিয়ষক সাময়িকী ডিপ্ল্যোম্যাট। ওই সাময়িকীতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের দুই অংশের মধ্যে উত্তেজনা জোরালো হতে পারে। সম্প্রতি দেশটির সেনানিয়ন্ত্রিত সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদীয় কমিটি তৈরির পক্ষে সে দেশের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হয়েছে।  তবে সংবিধান সংশোধনের আলোচনা শুরুর প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাস হলেও সেনা এমপিরা ভোটের প্রক্রিয়া বয়কট করে। প্রস্তাবটি উত্থাপনের পরপরই তারা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নীরব থেকে প্রতিবাদ জানান।

কথিত গণতান্ত্রিক উত্তোরণের নামে মিয়ানমারে আদতে জারি রয়েছে সেনাশাসন। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের যে কোনও প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস হতে হলে ৭৫ শতাংশের বেশি সমর্থন প্রয়োজন। অথচ দেশটির পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এনএলডি’র অন্যতম নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল এই সংবিধান সংশোধন করা। তবে  ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় তিন বছর পর ২৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো সু চি’র দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে সু চি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এমন পদক্ষেপ এটাই প্রথম।

ডিপ্ল্যোম্যাটের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘ বৃহৎ রাজনৈতিক বাস্তবতা চিন্তা করলে সংবিধান পরিবর্তনে এনএলডির এই প্রচেষ্টা চমক জাগানিয়া কিছু নয়। পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টা সবসময়ই তাদের ইস্যু ছিলো। তবে কখন এবং কিভাবে হবে সেটা স্পষ্ট ছিলো না। আলোচ্যসূচিতে বারবারই এটা প্রাধান্য পেয়ে আসছে। শুধুমাত্র নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি হিসেবেই নয়, বরং ‍সু চি ও তার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি সামনে এসেছে ২০২০ নির্বাচনকে ঘিরে এবং  দেশটি বৃহৎ রাজনীতিতে এনএলডি সরকারের অবস্থান প্রশ্নে এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, কারও পরিবারের সদস্যদের কেউ বিদেশি নাগরিকত্বের পরিচয় বহন করলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন। সু চিরও সন্তানদের বিদেশি নাগরিকত্ব থাকায় তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ২০১৬ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর সু চি নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার সংবিধানের বেশকিছু সংশোধনের অঙ্গীকার করেছে। আর চলতি সপ্তাহে প্রথমবারের মতো এনএলডিকে সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। সংশোধনী কমিটি করতে পার্লামেন্টে ভোট অনুষ্ঠিত হয় যা আইনবিভাগ থেকে সেটি অনুমোদনও পায়।ডিপ্ল্যোম্যাটের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে তৎকালীন সামরিক জান্তা কর্তৃক প্রণিত মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান নিয়ে বারবার সমালোচনা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে বিরত রাখার আইনটি।

ডিপ্ল্যোম্যাট বলছে, জয়লাভের পর এনএলডি সরকার খুব সতর্কতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করে যাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত নভেম্বরে উপ-নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় তারা এখন সমর্থন জোরালো করার চেষ্টা করছেন। সেজন্য নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার লক্ষ্য তাদের। ২০১৯ সাল সেটা করার জন্য সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ ২০২০ সালেই জাতীয় নির্বাচন। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই মুহূর্তে এনএলডি প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রভাব খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে এর প্রশ্নাতীত তাৎপর্য রয়েছে। স্পষ্টত কমিটি গঠনের প্রস্তাব পাস হওয়ার বিষয়টি তথা আইনপ্রণেতাদের ভোট জেতার সাফল্য প্রতিকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ সরকাররের কাঠামোবদ্ধ কৌশল হিসেবে এনএলডি একেই  সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সীমিতকরণের পথ হিসেবে নিয়ে সামনে এগোতে পারে।    

সংবিধান সংশোধনে কমিটি গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার অনুমোদনই যথেষ্ট ছিল। ডিপ্লোম্যাট বলছে, সে কারণেই প্রস্তাবটি পাস হতে পেরেছে। তবে এতেই প্রমাণ হয় না যে সংশোধনী আসবেই। কারণ সেটার জন্য ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট প্রয়োজন, আর সামরিক বাহিনীর কাছে ২৫ শতাংশ আসন রয়েছে। সামরিক বাহিনীও নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছে। এমনকি সংসদীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন সামরিক আইনপ্রণেতারা। তারা এমনও অভিযোগ করেছেন যে আইনি ক্ষমতার অপব্যাহার হচ্ছে। তবে এটা এখন পরিষ্কার যে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে মিয়ানমারে সামরিক-বেসামরিক সরকারের মাঝে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হবে।

সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে এনএলডি সরকারের আসলেই কি পরিকল্পনা সেটা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কারও। ডিপ্লোম্যাট বলছে, কমিটি গঠনের পর এবার সংশোধনের বিষয়বস্তু ও মাত্রাগত দিক নিয়ে দুই পক্ষের বাদানুবাদ হবে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মাঝে ক্ষমতার বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে মীমাংসা কঠিন। আর মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে সামরিক ক্ষমতা ও সু চির ক্ষমতার।

ডিপ্লোম্যাট বলছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‍সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও আন্দোলনের মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে তার। অভিযোগ উঠতে পারে যে এনএলডি সরকার জনগণ ও দেশের কথা না ভেবে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। তাই এনএলডি দুইদিন থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।  তবে কি হবে সেটা নিশ্চিত করে বলার তো সময় এখনও আসেনি। তবে ২০২০ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে।