যে কারণে মাইনাস বদি!

মুহিব‍বুল্লাহ মুহিব :

টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে নিজ দলের নেতাকর্মীদের অ-মূল্যায়ন। মাদক রাজ্য খ্যাত উখিয়া-টেকনাফে মাদকের গডফাদারের আসন দখলে নিয়ে নিজেকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন মাদকের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে। এসব অভিযোগই নাকি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য কাল হয়ে দাড়ায় কক্সবাজার-৪ উখিয়া-টেকনাফের আলোচিত-সমালোচিত এমপি আব্দুর রহমান বদির বিরুদ্ধে।

জানা যায়, আলোচনা-সমালোচনার এখানেই শেষ নয়। যখন থেকে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলীয় এমপি নির্বাচিত হয় তখন থেকে স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলে। এতে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার বড় অংশই বদি বিরোধী। তবে এত সব আলোচনা সমালোচনা বাঁধ ভেঙ্গে বিগত ১০ বছরে তৃণমূল ও দরিদ্র মানুষের সুখে-দুঃখে, আপদে বিপদে পাশে থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও ধরে রেখেছেন বদি। নিজেকে গরীবের বন্ধু হিসেবে জানান দিয়েছেন উখিয়া টেকনাফে। দলীয় প্রতীক নয়, বদি’র নামটিই সুনাম কুড়িয়েছে তার নির্বাচনী এলাকার আনাচে-কানাচে। বেশির ভাগ হতদরিদ্র মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত সাংসদ আবদুর রহমান বদি। জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্বেও বদনামগুলো কাল হচ্ছে এমপির বদির।

বদি গড়ফাদার হিসেবে অন্তরালে থাকলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ইয়াবা পাচারকারীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বদির ভাই মো. আবদুল শুক্কুর ও মৌলভী মুজিবুর রহমান, দুই সৎভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমানের নাম। এ চার ভাইকে দিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন আবদুর রহমান বদি এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

এছাড়া জ্ঞাতআয় বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে দুদকের রোষানলে পড়েন বদি। নির্বাচনী হলফনামায় দাখিল করা আয়কর নথির সঙ্গে বর্তমান সম্পদের অসামঞ্জস্য থাকায় বদির আয়কর নথি ও হলফনামা জব্দ করে দুদক। বদির সম্পদের অনুসন্ধানে এসে দুদকের উপ পরিচালক আহসান আলী কক্সবাজার থেকে বদির হলফনামা ও আয়কর বিবরণী জব্দ করেন।

দুদক অনুসন্ধান চালিয়ে আবদুর রহমান বদির ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পায়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বদির বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ৩ বছর কারা ভোগও করেন তিনি।

এখানেই অভিযোগের শেষ নয়, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধরের ঘটনায় আলোচনায় আসেন বদি। এরপর তার হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেকে। এভাবেই তিনি সমালোচনার জন্ম দিয়ে বিতর্ক হয়ে উঠেন।

২০১১ সালের ২৯ জানুয়ারি টেকনাফ পৌরসভা নির্বাচনে চাচা মো. ইসলামের জন্য ভোট কারচুপিতে বাধা দেয়ায় এমপি বদির মারধরের শিকার হন নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সর্বশেষ বদির হাতে লাঞ্ছিত হন নিজদল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং। ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বদির অনুরোধে সাড়া না দেয়ায় বীর বাহাদুরকে লাঞ্ছিত হতে হয়।

এতো আলোচনা-সমালোচনার গ্যাড়াকলে পড়েও একাদশ সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন বদি। টানা দু’বার সংসদ সদস্যের অভিজ্ঞতার থলি নিয়ে অলিগলিতে জানান দিচ্ছেন বদি। আগামীতেও তিনি উখিয়া-টেকনাফের আসনটি নিজের দখলে নিতে চান বদি। তবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নামলেও এবার বদি বাদ পড়ছেন বলে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত অথবা আওয়ামী লীগ; যে আমলেই হোক, যেভাবেই হোক সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন আবদুর রহমান বদি। বিএনপির কাছে মনোনয়ন চেয়েছিলেনও। তবে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়েই পার হয়েছেন বৈতরণী। এরশাদ সরকারের সময় বদির বাবা এজাহার মিয়া ছিলেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। বাবার কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি সমালোচিত এই এমপির। এরশাদ সরকারের পর বদির বাবা যোগ দেন বিএনপিতে।

সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ও ১৯৯৬ সাল ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে জিততে পারেনি আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন বদি। টেকনাফে শুরু হয় বদির বদ শাসন। হয়ে ওঠেন অন্ধকার জগতের মুকুটহীন সম্রাট।

এবিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল রহমান বদি বলেন, আমি একজন এমপি। আমার পক্ষে বিপক্ষে মানুষ থাকতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনী মাঠে আমার বিরুদ্ধে বিশাল একটি চক্র আছে। চক্রটি সব সময় আমাদের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ তুলে। এসব কাল্পনিক। সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন লোকজনকে মারধরের বিষয়টিও সত্য নয়। তিলকে তাল বানিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

তিনি আরও বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দল যাকে মনোনয়ন দেন আমি তার পক্ষ হয়ে কাজ করবো। উখিয়া টেকনাফ ঘুরে দেখলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কার জনপ্রিয়তা বেশি। এতে দল যাকে ভালো মনে হবে ওনাকেই নির্বাচন করতে বলবেন।