রোহিঙ্গাদের অপেক্ষায় ভাসানচর

চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি বেয়ে এগোতেই এক টুকরো সবুজ দ্বীপ। বছর পাঁচেক আগেও সেখানে ঘুরে বেড়াত বুনো মহিষ। ছিল বন ও জলদস্যুদের আস্তানা। জোয়ারে যে চর পানিতে ভাসত, সেই চরে এখন ঘটেছে প্রকৃতি আর অবকাঠামোর অভূতপূর্ব মেলবন্ধন। প্রায় দুই যুগ ধরে জমেছে পলি, শক্ত হয়েছে ভিত। সমুদ্রবেষ্টিত ১৩ হাজার একর আয়তনের এই সবুজ ভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদ আবাসন।ভাসানচরের জেটিতে জাহাজ থেকে নেমে কংক্রিটের রাস্তায় এক কিলোমিটার গেলেই মিলবে ভিন্ন এক জগৎ। ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি সবুজ এই ভূমিতে শুরু হয় দালানকোঠা গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ। মাত্র দুই\হবছরে এই চর হয়ে উঠেছে আধুনিক নগর। সারি সারি কংক্রিট আর লাল ছাউনির সুন্দর গোছানো বাড়ি সেখানে। বিদ্যুৎ, স্কুল, মসজিদ, বিশুদ্ধ পানি, টেলিযোগাযোগ, কৃষিখামার, পাকা সড়ক, আধুনিক বাজার, উন্নত স্যানিটেশন, দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বিনোদনের ব্যবস্থা, হাসপাতাল, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ, খেলার মাঠ- কী নেই ভাসানচরে? সব নাগরিক সুবিধাই রাখা হয়েছে এখানে। এই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী বা শরণার্থীদের জন্য এমন আবাসন গড়ে তোলার উদাহরণ বিশ্বে বিরল।\হমিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। নোয়াখালীর হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অধীন এই দ্বীপ এখন রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাতে পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তি আর রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে এখনও স্থানান্তর শুরু করতে পারেনি সরকার। তবে এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল, বিভিন্ন এনজিওসহ নানা সংস্থার প্রতিনিধিরা ভাসানচর ঘুরে গেছেন। তারা পরিকল্পিত এমন অবকাঠামো দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।\হগত রোববার ভাসানচরে যান ২২টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শতাধিক কর্মী। সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে যান ৬০ টন খাবারও, যা জমা আছে ভাসানচরের খাদ্যগুদামে।

এনজিও কর্মকর্তারা দু’দিন ধরে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নির্মিত আবাসন, স্কুল, মসজিদ, খেলার মাঠসহ নানা অবকাঠামো। সাগরের বুকে জেগে ওঠা এক টুকরো ভূমিতে অন্য রকম এই নিরাপদ নগরী দেখে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের প্রত্যাশা, উন্নত জীবনযাপনের আশায় দ্রুতই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভাসানচরে আসবেন। সে লক্ষ্যেই ভাসানচরকে প্রস্তুত করা হয়েছে। গত রোববার নিরাপত্তার জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ২১৩ জন সদস্য চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে ভাসানচরে পৌঁছান। তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও দু’জন সহকারী পুলিশ সুপার। এ ছাড়া ভাসানচর পুলিশ ফাঁড়িতে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অধীনে আগে থেকেই নিয়োজিত রয়েছেন ৩০ সদস্য। নিরাপত্তা টহলের জন্য এসেছে যানবাহন। প্রস্তুত মেডিকেল টিমও।

গত সোমবার ভাসানচর পরিদর্শনকারী এনজিও সংস্থাগুলো হচ্ছে- পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর), ফ্রেন্ডশিপ, ছাওয়াব, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সেবা সংস্থা, আল-মানহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেল্প দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসেবা কেন্দ্র, কারিতাস বাংলাদেশ, সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সেন্টার ফর হিউম্যানিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি), মুক্তি কক্সবাজার, ভলান্টারি অরগানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল (এমএসআই), আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (এইচএইএফএ)।

নানা অবকাঠামো নিরীক্ষণের পর পালস বাংলাদেশ সোসাইটির সহকারী প্রকল্প সমন্বয়ক তুহিন সেন জানান, মানুষের বসবাসের জন্য কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচর অনেক বেশি উপযোগী। ভাসানচরের যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক ভালো। কক্সবাজারে পাহাড় ধসের ঝুঁকি থাকলেও এখানে নেই। ভাসানচরে উন্নত শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ কক্সবাজারে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। তিনি বলেন, এখানে পারিবারিকভাবে বসবাসের পরিবেশও চমৎকার। কক্সবাজারে ৫-৬ ফুটের ঘর, কিন্তু ভাসানচরের ঘর বড়।
\হমাল্টি সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল (এমএসআই) স্যানিটেশন, শিক্ষা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এই সংস্থার প্রজেক্ট ইনচার্জ মোজাম্মেল হক বলেন, কক্সবাজারের সঙ্গে ভাসানচরের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই নাজুক ও অস্বাস্থ্যকর। ভাসানচরে আধুনিক ও উন্নতমানের টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র কয়েকটি টিউবঅয়েল, তাতেও বিশুদ্ধ পানি মেলে না। অথচ ভাসানচরে প্রতিটি রুমে টিউবঅয়েল বসানো হয়েছে। ঘরগুলোতে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজারে ছোট্ট জীর্ণ ঘরে চলছে পাঠদান। ভাসানচরে পড়াশোনার জন্য রয়েছে উন্নত ভবন। খেলার মাঠসহ শিশুদের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে সবকিছু।

ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় ভাসানচরে রয়েছে এক হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার। চারপাশে নয় ফুট উঁচু ১৩ কিলোমিটার শক্তিশালী বাঁধ ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট তৈরি করা হয়েছে। পণ্য পরিবহন ও মানুষ পারাপারের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে চারটি জেটি। আছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এনজিও সংস্থা ছাওয়াবের সমন্বয়ক ইমদাদুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারের বসতি রোহিঙ্গাদের উপযোগী নয়। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উঁচু-নিচু। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের ঝুঁকি। ভাসানচরে প্রাকৃতিক কোনো ঝুঁকি আপাতত নেই।\হআরটিএম ইন্টারন্যাশনাল নারীদের প্রসবকালীন সেবা নিয়ে কাজ করে। এই সংস্থার মিডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট এনাম আহমেদ বলেন, কক্সবাজারে প্রসবকালীন নারীরা সেবা পান না বললেই চলে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় দ্রুত রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। অথচ ভাসানচরে দুটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি প্রসবকালীন নারীর জন্য সিজার ও নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরিভিত্তিতে অন্য কোথাও নিতে হেলিকপ্টার, জাহাজ ও স্পিডবোট প্রস্তুত আছে।
\হসেন্টার ফর হিউম্যানিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) কো-অর্ডিনেটর প্রসেনজিৎ বৈদ্য বলেন, তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করেন। সেখানকার পরিবেশ প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব। অথচ ভাসানচরে সবদিক দিয়েই উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। এখানে কাউকে গাদাগাদি করে থাকতে হবে না। উন্নত নাগরিক সুবিধাও রয়েছে। তাই কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা উচিত বলে অভিমত দেন তিনি।
বেসরকারি সংস্থা হেল্প দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল হাসান বলেন, ভাসানচরে নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সরকারের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা এখানে এলে তাদের জীবনটাই বদলে যাবে।

ভাসানচরে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩’-এর উপ-প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির বলেন, ১২০টি ক্লাস্টার নিয়ে তৈরি ভাসানচর এক লাখ মানুষের আবাসনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়াও এখানে এনজিও কর্মকর্তা, দূতাবাসের কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য উন্নত ও আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অপেক্ষায় আছি, রোহিঙ্গারা এখানে আসবেন এবং থাকবেন। তাদের যতদিন না নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, ততদিন তারা এখানেই থাকবেন। তারা ফিরে গেলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এসব আবাসন ব্যবহার করা হবে।