সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস

সকালে উঠেই খোলা বারান্দায় একটি শালিক দেখলেন। ব্যস, মনে হলো এটা কোনো অলক্ষণ, যাত্রা অশুভ বা আপনার সারাদিন বোধহয় মাটি। কারণ আমাদের কাছে মনে হয় জোড়া শালিক দেখাটা মঙ্গলজনক। আর একটা শালিক মানে চরম অলুক্ষণে কিছু। ধরুন আপনার সেই দিন খারাপ কিছু ঘটে গেলো। আপনি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলেন, ভাবলেন সকালে সেই এক শালিক দেখেই আপনার এই অবস্থা।

আমাদের সমাজে এমন কিছু ধারণার খুব বেশি প্রচলন রয়েছে। ভ্রান্ত সমাজ তাকে সংস্কার বললেও আধুনিক সমাজে একে বলে কুসংস্কার। বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো ভিত্তিই নেই। এরকম বহু কুসংস্কার আছে, বলতে গেলে শেষও করা যাবে না।

কি কি কুসংঙ্কার আমরা বেশি মেনে চলি

বাসার বাইরে বের হতে গিয়ে ধাক্কা খেলে মনে করা হয় এটা খারাপ লক্ষণ। এটা হয়তো কোনো কারণে বাইরে যেতে দিতে বাধা দিতে চাচ্ছে। আবার বের হওয়ার সময়ে হাঁচি পেলে সেটাও অশুভ মনে করা হয়।

আবার জোড়া কলা খেতে গিয়েও আমরা থেমে যাই। ভাবি জোড়া কলা খেলে সন্তানও হবে জোড়া। তেমনি কোনো জোড়া ফল খেতে গেলে থেমে যাই আমরা।

গোল্লা পাওয়ার ভয়ে ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে এখনো অনেকে যেতে চায় না। এতে নাকি পরীক্ষায়ও ডিম পাওয়ার আশঙ্কা থাকে!

আবার বামচোখের পাতা লাফালে আমরা ভীত হয়ে পড়ি, মনে হয় এই বুঝি কোনো বিপদ আসছে। কোনো বিপদ হলে সেটা চোখ লাফানোর ঘটনার সঙ্গে মিলিয়েও নিই।  

ডান হাতের পাতা চুলকাচ্ছে, খুব আনন্দ হবে তখন। মনে হবে এই বুঝি এবার হাতে টাকা আসবে। কারণ আমরা জেনেই আসছি যে ডানহাত চুলকালে টাকা আসে।

কেউ আবার মঙ্গল বা শনিবার অমঙ্গল কিছু ঘটার আশঙ্কায় জরুরি প্রয়োজন থাকলেও কোথাও যাত্রা করে না। এটা নাকি অমঙ্গলজনক।

পথে কালো বিড়াল দেখলে সেটা অমঙ্গলের, যাত্রা অশুভ। আবার কোনো কথা বলার সময় টিকটিকি যদি টিক টিক করে শব্দ করে তাহলে সেই শব্দকে ঐ কথার সত্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আবার কখনো রাতে পেঁচা বা কাকের ডাককেও অশুভ মনে করা হয়। খুব প্রচলিত হলেও এগুলো কুসংস্কারের প্রতি অন্ধবিশ্বাসের ফল।

কুসংস্কারের সঙ্গে অন্ধবিশ্বাস অবশ্যই জড়িত

যুগ যুগ ধরে কুসংস্কার টিকে থাকে শুধু মানুষের বিশ্বাসের কারণে। কেননা যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় কুসংস্কার ভিত্তিহীন। মানুষ অমঙ্গলের ভয়ে বিভিন্ন হাস্যকর বিষয়ও বিশ্বাস করে মেনে চলে। তাদের অন্ধ বিশ্বাসই কুসংস্কারকে অন্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় আর বছরের পর বছর সেগুলোকে প্রচলিত রাখে। কুসংস্কারে বিশ্বাসীদের কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এত দৃঢ় হয় যে তারা কুসংস্কারগুলোকে অবশ্য পালনীয় মনে করে। কোনোরকম বুদ্ধি-বিবেচনা ছাড়াই তারা কুসংস্কারে অন্ধ বিশ্বাস রাখে।

কুফলগুলো জানা থাকা ভালো

‘কু’ উপসর্গটি মানেই খারাপ বা অশুভ কিছু। তাই ‘কুসংস্কার’মানেই দাঁড়ায় কু যে সংস্কার। অর্থাৎ যে সংস্কার মানুষের জন্য ভালো নয়। এই সংস্কার না মানলে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। এটা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বরং এই কুসংস্কার আমাদের ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়। কুসংস্কার আমাদের বরং পিছিয়ে রেখেছে। গ্রামীণ অঞ্চলে কুসংস্কার বেশি মানলেও শহরাঞ্চলেও এর দৌঁড় কম না।  কুসংস্কারে বিশ্বাস সত্যের অনুসন্ধানকে খর্ব করে। বার বার একই সমস্যায় পড়তে হয়, সাফল্য থেকে পিছিয়ে থাকতে হয়। মানুষ সামনে অগ্রসর হতে না পেরে পেছনে টানতে থাকে। ফলে কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ বর্তমান সময় আর যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। এই অন্ধবিশ্বাস তাদেরকে কুয়োর ব্যাঙ করে রাখে।

সংস্কার-কুসংস্কার ও বিজ্ঞান

সংস্কার, কুসংস্কার ও বিজ্ঞান তিনটি বিষয়ই একটি অন্যের বিরোধী। সংস্কারের সৃষ্টি মানুষের মঙ্গলের জন্য, নিয়মের মধ্যে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য। আর কুসংস্কার সংস্কারের বিকৃত রূপ। বিজ্ঞান সবসময়ই যুক্তি আর প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই বিজ্ঞান কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করে বিরোধীতা করে। বিজ্ঞান কোনো ঘটনার পেছনের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু কুসংস্কার পুরোটাই যুক্তিহীন। এজন্য বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করুন। প্রযুক্তির যুগে এসে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই মানায় না।

এই বিশ্বাসগুলো থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় উপায় হরো নিজেকে বদলানো। এজন্য হয়তো আপনাকে সমাজের সঙ্গে বিরোধিতা করতেও হতে পারে। মনের অজ্ঞতাকে দূর করুন সবার আগে।

বাস্তববাদী হোন। মনে রাখবেন কুসংস্কারের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। সবকিছু প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে। কোনোকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কিছু ঘটে না। সবেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা আছে। বাস্তব সবসময়েই বাস্তব।

আপনার চারপাশে যে মানুষগুলো টুকিটাকি কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, আপনার উচিৎ হয় তাদেরকে এড়িয়ে চলা, নয়তো তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসা। কুসংস্কার নিয়ে নিজেও বিভ্রান্ত হবেন না, অন্যকেও বিভ্রান্ত হতে দেবেন না।