স্থানীয় ছাটাইয়ের নেপথ্যে

এমডি ম্যাক্স:

ইনফ্লাক্সের প্রথম দিকের কথা। তখন এফ ডি-৭ ছাড়াই সবাই কাজ করতে পারতেন। শত শত চ্যারিটি গ্রুপ। অনেক বেসরকারি সংস্থা আর ব্যাক্তিগত সাহায্যে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া শুরু।

এরই মাঝে আমি অনেক মিডিয়ার সাথে অনুবাদে ব্যস্ত, পরে যখন বিভিন্ন এনজিওকে ফিক্সিং এর কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়। তখন আমার কাছে আসে এম,টি,আই (মেডিকেল টিম ইন্টারন্যাশনাল)।

তাদের বাড়ি ভাড়া, গাড়ী, অনুবাদক,রাধুনি, ড্রাইভার, দারোয়ান থেকে শুরু করে লজিস্টিক অফিসার,ভলান্টিয়ার সব যোগাড় করে দিলাম, কিছুদিন পরে অফিসে গিয়ে দেখি তাদের মার্কেটিং অফিসার যাকে আমি নিয়োগ দিয়েছিলাম তিনি ছাটাই হলেন, কারন জানতে চাইলাম, একজন বললেন, এফ, এইচ ( ফুড ফর হাংগেরি) এসেছে, ওনারা বাইরের একজন কে নিয়োগ দিয়েছেন, পরে দুজন অনুবাদক বাদ, নতুন কুষ্টিয়া থেকে আসা তারা না জানে ইংরেজি বলতে না বুঝে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা!

এভাবেই একসময় গিয়ে দেখি স্থানীয় রাধুনির চাকরিই গেল, স্থলাভিষিক্ত হলেন নোয়াখালীর আরেকজন, হাতে সিগারেট নিয়ে রান্না করছেন তিনি।

ডি, আর, সি ( ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল) আসল আমার কাছে, গাড়ি দরকার আর ওয়ারহাউস ( গুদাম) লাগবে, সব আয়োজন করে দিলাম, একমাস পরে দেখি, নতুন গাড়ি, নতুন গুদামঘর, নেত্রকোনার একজন নতুন সব ব্যাবস্থা করে দিলেন।

তাদের সাইট ম্যানেজমেন্ট দ্বায়িত্ব আছে বিভিন্ন ক্যাম্পে, সেখানে টিম লিডার বহিরাগত, কর্মীরা বহিরাগত, ক্যাম্প ম্যানেজার বহিরাগত, স্থানীয় হাতেগোনা, যে সমস্ত এন,জি,ও সাইট ম্যানেজমেন্ট এর দ্বায়িত্বে আছে তাদের সবার সিংহভাগই বহিরাগত, রোহিঙ্গা মাঝি, মহিলা, ভলান্টিয়ার সবার হিমশিম খেতে হচ্ছে ভাষা না বুঝার কারনে।

আমরা যারা ক্যাম্পে কাজ করি এতে দেখা যায়,কয়েক ডজন সেক্টরে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ফোকাল পারসন থাকেন,,তারা অধিকাংশই বহিরাগত, শিক্ষা প্রকল্পের কথাই ধরি সেখানে দেখা যায়, রোহিঙ্গা আর আমাদের স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বহিরাগত যাদের কিঞ্চিৎ পরিমাণ কে ও বুঝতে পারছেননা।

অথচ আপনি একটি কমিউনিটিকে চাল, ডাল দিবেন, তাদের বাচ্চাদের পড়াবেন, তাদের রেজিস্ট্রেশন করাবেন, এই রোহিঙ্গাদের জন্যে নলকুপ স্থাপন করবেন, তাদের প্রতিরক্ষার আওতায় গাইড লাইন দিবেন, তাদের চিকিৎসা দিবেন সেখানে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়না।
এসমস্ত কাজ দিব্যি আমাদের লোকবল করতে পারবেন অনায়াসেই।

বহিরাগতদের আরেকটি স্বভাব দেখলাম তারা সি আই সি দের অনেক বেশী তেলমর্দন করেন, একথা সত্যি যে অনেক সি, আই, সি ক্যাম্পে অনেক বেশী পরিশ্রম করে তাদের দ্বায়িত্ব পালন করেন, বিশেষ করে এই ক্যাম্প গুলো চালানো খুবই চ্যালেঞ্জের, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে এক খণ্ড জায়গা এখন খালি নেই, প্রতিনিয়ত এক এন,জি,ও আরেক এন,জি,ও তাদের প্রকপ্ল বাস্তবায়নে কলহে লেগেই আছে, সি আই সি দের এসব সামলানোর পাশাপাশি দিতে হচ্ছে মানবিক সেবার কার্যক্রমের সঠিক দিক নির্দেশনা, ৪ নং ক্যাম্পের সি আই সি পাভেল প্রতিদিনই স্থানীয়দের চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছেন, সি আই সি ওবায়দুল্লাহ সারাদিন বিভিন্ন ব্লকে গিয়ে সব কাজ নিবিড় পর্যবেক্ষন করেন।

সমস্যা একটিই বিদেশী এবং সি আই সি, সবাইকে বহিরাগতরা কিছু বোঝার আগেই আমাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোবাসনা ঢুকিয়ে দেন।
এতে আমাদের পাশাপাশি ঠকে যাচ্ছেন বিদেশী আর প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ।

এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার মত বহিরাগত যারা আমাদের আঞ্চলিক ভাষা যেটি এই মুহুর্তে ক্যাম্পে সবচেয়ে জরুরি তা জানেন না, বিভিন্ন সংস্থা যেমন UNHCR, UNICEF, IOM, WFP,WHO, UNDP, UN WOMEN, MSF, SAVE THE CHILDREN, ACF, ACTED, DRC, FHMTI, BRAC, CARE, RELIEF INTERNATIONAL, CHRISTIAN AID, IRC সহ এন,জি,ও তে সবাই কাজ করে যাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য, ওয়াস,শিক্ষা,ফুড চেইন, সাইট ম্যানেজমেন্ট, পুষ্টি, সুরক্ষা, অনুবাদ, লজিস্টিক, প্রকিউরম্যেন্ট,এডমিন, এইচ,আর থেকে শুরু করে কোন পজিশনে কোন স্থানীয়দের চাকরি নেই, টিম লিডার, ফোকাল পারসন , ক্যাম্প ম্যানেজার সবই বহিরাগত।

শুধুমাত্র চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ৫০% নাম্বার দিলেই আমাদের লোকালদের চাকরি হয়ে যায়।

জরুরি অবস্থায় ও এই সমস্যা দেখা গিয়েছিল, ঢাকা থেকে যে বিদেশী সাংবাদিকরা ফিক্সার নিয়ে আসতেন তারা এখানে ভাষা না বুঝার কারনে তাদের স্থানীয় আরেকজনকে নিতে হত, এতে বাড়তি টাকা গচ্ছা যেত, পরে তারা বুঝতে পেরেছেন এখানেও ভালো অনুবাদক আছেন।

শরনার্থী ক্যাম্পের এই কাজগুলো আমাদের কক্সবাজারের যে কোন শিক্ষিত যুবকরাই করতে পারবেন, আমাদের ছেলেদের রয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভাষার দক্ষতা, আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।

সবচেয়ে বেশী টেকনাফ, উখিয়া আর কক্সবাজারবাসী ক্ষতিগ্রস্ত বলেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন এখানকার জনসাধারণের সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়ার। পক্ষান্তরে কোন অফিস লোকালদের সি, ভি চেক করেনা৷
বিডি জবসের মাধ্যমে অনলাইন আবেদন করার পরেও ডাকেনা আমাদেরকে।

কিছুদিন আগে একটি আই, এন,জি,ও এর ট্রেনিং করিয়েছি, প্রায় ৮০ জন কর্মী তারমধ্যে ৬৫ জনই বহিরাগত, শুধুমাত্র ১৫ জন আমাদের, ১০ জন আমার ছাত্র, তাদের চেয়েও ভাল ছাত্রছাত্রী আমার জানা আছে, তাহলে কোথাও কোন হেরফের হচ্ছে যার কারনে বাকীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

ইউ, এন এজেন্সির সাইন আপ গুলো অনেক জটিল কতে রাখা হয়েছে, জবস মেলা বলে সবাইকে ঢেকে আর নেই কোন খোজ, অনেক বিদেশী আশ্চর্য্য হয়ে যান কক্সবাজারের অনেকের ইংরেজি কথা বলার পারদর্শিতা দেখে, কিন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে কেউ সুযোগই পাচ্ছেনা।

পালস বাংলাদেশের কলিম উল্লাহের মতে তার সংস্থায় প্রায় ১৫০ জনের মত কাজ করছেন, সবাই স্থানীয়, এর কারনে তিনি তাদের অগ্রাধিকারের কথাই জানান।

গত এক বছর থেকেই গ্রান্ড বারগেইনে কোষ্ট ট্রাষ্টের রেজাউল করিম চৌধুরী গলা ফাটিয়েছেন স্থানীয়করনের জন্যে। তার সাথে আছেন পালস এর আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।

ত্রাণ কমিশনের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, আবুল কালাম, মিজানুর রহমান আর শামসুদোজা প্রায় প্রতিদিনই কিভাবে কক্সবাজারের ক্ষতিগ্রস্তদের মিটিগেট করা যায় তা নিয়ে খুবই সজাগ, কিন্তু কোনরূপ আশার দুয়ার খোলছেনা, এর কারন, বহিরাগতরা সবসময় স্থানীয়দের বিষাদগার করে যাচ্ছেন ।

উখিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান আমাদের আঞ্চলিক ভাষার মানুষ বলে তিনি সবচেয়ে আমাদের কষ্টটা কাছে থেকেই বুঝতে পারেন। বিভিন্ন মিটিং এ প্রায় তিনি এব্যাপারে তাগিদ দেন।

আমার এই লিখার কারনে হয়তোবা আমাকে অনেকেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নাও নিতে পারেন কিন্তু আমার কাছে দেশপ্রেম আগে।

আমরা কক্সবাজার বাসী আন্দোলনের নেতাদের মতে, এইসব চাকরি আর সুযোগ আমাদের প্রতি করুনা নয়, এসব আমাদের অধিকার।

আজ আপনি আমার সাথে আসেন কোন একটি এন,জি,ও অফিস পরিদর্শনে, সেখানে শুরুতেই দেখবেন, যে দারোয়ান আপনাকে আটকাবে তিনি একজন বহিরাগত, ফ্রন্ট ডেক্সের চেয়ারে বসা রিসেপসেনিস্ট বহিরাগত, একটি রুমে ৫ চেয়ার আর ডেক্স নিয়ে বসা তার ৪ জনেই বহিরাগত, নিয়োগ কর্মকর্তা বহিরাগত, প্রকিউরম্যান্ট অফিসার বহিরাগত, এডমিন বহিরাগত, গুটিকয়েক লজিস্টিক আমাদের কক্সবাজারের।

এই হল দৃশ্য বর্তমানে আমাদের কক্সবাজারের।

একটি প্রজেক্ট দেখিয়ে সব বাজেট নিয়ে আসছে অনেক এন, জি,ও। খালি পরে আছে অনেক পোস্ট, কিন্তু নেই আমাদের কোন লোকজন।

কথা হল অতীতের অনেক দাবী আদায়ের আন্দোলনের মত এব্যাপারের সংগ্রাম যদি বৃথা যায় তাহলে তা হবে ব্যর্থতার গহবরে আরো ঢুকে যাওয়া।

আমাদের চাহিদা খুবই কম, ভাষার উপর বেশী নাম্বারে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হউক, নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে যাচাই বাচাই হউক, আর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হউক।

আমাদের সময় এসেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানবিক সহায়তা দেওয়ার পর এবার নিজের জেলা কক্সবাজার কে গড়া।

লেখক: একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ফিক্সার এবং অনুবাদক।