হজরত আলী ও উমর যখন শ্রমিক

আজকের দুনিয়ায় একমাত্র আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের ওপরই মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ভরশীল। নৈতিকতা বা মানবতার বিচারে সে যত জঘন্য প্রকৃতিরই হোক না কেন, মোটা অঙ্কের ব্যালেন্স থাকলেই সামাজিকভাবে সব উপকরণ আয়ত্তে চলে আসে তার।

পক্ষান্তরে বিত্তহীন বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হলেও আধুনিক সমাজব্যবস্থার মাপকাঠি অনুযায়ী তার কোনো মূল্য নেই।

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। একজন শ্রমিক, যেহেতু তার কোনো অর্থবল নেই, তাই আজকের শ্রমিকদের অবস্থা প্রাচীনকালের দাসদের সামাজিক মর্যাদার চেয়েও হীন। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় সজাগ করতে।

ইসলামের দৃষ্টিতে আর্থিক সঙ্গতিই শুধু সমাজে স্থান লাভের উপায় নয় বরং প্রত্যেক সৎকর্মশীল পরহেজগার ব্যক্তিই মর্যাদাবান হতে পারে। সে জন্মগত বা পেশাগত দিক থেকে যত নিচু মানেরই হোক না কেন, সে আপন কর্মের মাধ্যমে সমাজে মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পায়।

এ মৌলিক সত্যটির দিকেই ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- তোমাদের মধ্যে তারাই বেশি মর্যাদাবান যারা অধিক আল্লাহ ভীরু, পরহেজগার। ইসলামের ইতিহাসে দেখতে পাই, একজন সৎকর্মশীল পরহেজগার শ্রমজীবী অনেক উঁচু মর্যাদায় পৌঁছেছেন।

পেশায় শ্রমিক বলে এখানে তার মর্যাদাহানিকর কোনো পরিস্থিতি নেই। ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষিত করেছে। আমরা জানি, খোদ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একজন শ্রমজীবী ছিলেন।

অনেকদিন পর্যন্ত তিনি নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের অংশীদার হিসেবে হজরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসায় খেটেছেন। তাঁর মতো একজন বিত্তহীনের সততা ও প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়েই খাদিজার মতো বড় পুঁজির অধিকারিণী এক মহীয়সী নারী তার গলায় বিয়ের মালা পরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

হজরত আলী তার মেহনতি জিন্দিগির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলতেন, মদিনায় থাকাকালীন একবার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শহরতলির দিকে কাজের তালাশে বের হয়ে পড়লাম। এক স্থানে একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখতে পেলাম।

মনে হল সে হয়তো মাটি ভেজাবে। তখন এক একটি খেজুরের বিনিময়ে এক এক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দেয়ার কাজ করলাম। পর্যায়ক্রমে ষোল বালতি পানি তুললাম। এতে আমার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। কাজ সেরে হাত-মুখ ধুলাম।

মেয়েটি আমাকে ষোলটি খোরমা পারিশ্রমিক দিয়ে দিল। তা নিয়ে নবী করিমের কাছে এলাম। ওই ঘটনা বর্ণনা করার পর নবী করিমও আমার সঙ্গে তা খেলেন।

ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমরও (রা.) একজন রাখাল শ্রমিক ছিলেন। মক্কার অদূরবর্তী কাদিদ থেকে দশ মাইল দূরে জান্ জান্ ময়দানে তাকে উট চরাতে হতো। খিলাফতের পর একবার এ মাঠ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন।

পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল, চোখে পানি এলো। সঙ্গীদের তখন নিজের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, এমন এক সময় ছিল যখন ঘোড়ার জিনের মামুলি এক টুকরো কাপড় পরে এ মাঠে আমি উট চরাতাম। পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লে পিতা বেদম প্রহার করতেন। আর আজ, আল্লাহ ছাড়া আমার ওপর কেউ হাকিম নেই।

একবার দরবারে নববীতে হজরত উমর (রা.) এর জবান থেকে বের হয়ে পড়ল, বিলাল, তুমি কাল এক হাবশী। এ শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, উমর, এখনও তোমার মধ্যে জাহিলিয়াতের অন্ধ আভিজাত্যের গন্ধ রয়ে গেছে।

একবার আবুজর (রা.) এর সঙ্গে হজরত বিলালের মনোমালিন্য হল। আবুজর আরবের অভিজাত গোত্র গিফারের সরদার ছিলেন। তিনি নিজেকে হজরত বিলাল (রা.) অপেক্ষা কিছুটা উচ্চবংশজাত মনে করেছিলেন। তাই তিনি তাকে বলে উঠলেন, আও! বান্দির বেটা।

নবী করিম (সা.) যখন এ কথা শুনলেন তখন আবুজরকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি একে গালি দিয়েছ? তিনি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন। নবী করিম (সা.) সঙ্গে সঙ্গে এদের প্রকৃত মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত বললেন, আবুজর, এরা তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমত করছে।

ইসলাম সামাজিক আচার-ব্যবহারের বেলায় মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান দূর করেছে, এমনকি, নামগত পার্থক্যও দূর করে দিয়েছে। শ্রমিকদের মর্যাদাহানিকর কোনো শব্দ ব্যবহার পর্যন্ত ইসলাম নিষেধ করেছে। কোনো দাস-শ্রমিককে দাস বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ শ্রমিককে ‘দাস’ বলে ডাকতে পারবে না। কারণ তোমরা সবাই গোলাম। একমাত্র আল্লাহই সবার রব বা প্রতিপালক।

লেখক : প্রাবন্ধিক