১০ বাংলাদেশির কাছে হারলো ইতালীর সিসিলির দুর্ধর্ষ মাফিয়া গ্যাং

অনলাইন ডেস্ক – ইতালীর সিসিলি দ্বীপের রাজধানী পালার্মোতে ১০ বাংলাদেশির সাহসিকতায় সমূলে উৎপাটিত হয়েছে ২৫ বছর পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠা ভয়ংকর মাফিয়া সিন্ডিকেট ‘ক্যুপোলা’ 

পালার্মোতে ১০ জন বাংলাদেশি মিলে সম্পূর্ণ অহিংস উপায়ে রুখে দিয়েছে ২৫ বছর পর পুনরুত্থিত ভয়ংকর মাফিয়া সিন্ডিকেট ‘ক্যুপোলা’ গ্রুপকে। সম্প্রতি তাদের এই অবিশ্বাস্য বিজয়গাঁথার গল্পটি উঠে আসে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সিসিলি দ্বীপটিতে মাফিয়াদের রাজত্ব। সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে দ্বীপটিতে স্থানীয় লোকজনের চেয়ে অভিবাসীদের সংখ্যাটাই বেশি। যার মধ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশি ছাড়াও আরব, আফ্রিকান ও অন্য এশীয় দেশের অভিবাসীসহ প্রায় ২ লক্ষ অভিবাসীর বসবাস এই দ্বীপে।

তবে দ্বীপটিতে সংখ্যায় বেশি হলেও বাংলাদেশিসহ অন্যদেশীয় অভিবাসীদের মাফিয়াদের চরম অত্যাচারের মধ্যে দিনানিপাত করতে হতো। চাঁদাবাজি তো আছেই, ভয় দেখানো, হত্যা, গুম, খুনকে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছিল মাফিয়ারা।

মূল ঘটনার শুরু ২০১৬ সালে। এক বিকেলে স্থানীয় মাফিয়া রুবিনো গুলি করে বসে এক গাম্বিয়ান অভিবাসী ইউসুফা সুসোর মাথায়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় অভিবাসীদের। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে স্থানীয় অভিবাসীরা। আর তাদের নেতৃত্বে একদল বাংলাদেশি। তারাই হয়েওঠে আন্দোলনের নেতা।

তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় তিউনিসিয়া, গাম্বিয়া, নাইজেরীয় এবং অন্যান্য বাংলাদেশি অভিবাসীরা। তাদের সাথে হাত মেলায় সিসিলীয় অ্যাকটিভিস্টরাও। স্থানীয় আদালতে মামলা দেওয়া হয় রুবিনোর বিরুদ্ধে। শুধু রুবিনোই নয়, মামলার আসামি করা হয় তাদের গডফাদারদেরও। অনেক হত্যার হুমকি, অত্যাচার নেমে আসলেও পিছপা হননি ওই নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশিরা।

আটক হয় বন্দুকবাজ রুবিনো। এর দুই বছর পর গত নভেম্বর মাসে পালার্মোর আদালত রুবিনোকে দোষী সাব্যস্ত করে।

এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী নেতাদের একজন এবং স্থানীয় বাংলাদেশি সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল তপু সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি এখানে ২০ বছর ধরে আছি। মামলা চলার সময় একজন আমার দোকানে এল। আমি তাদের বললাম, আর যদি আমার এখানে দেখি, তাহলে যা করার করব”। এর পর পাল্টা হুমকি সত্ত্বেও পিছপা হননি তিনি।

তিনি বলেন, “এখানে থাকতে হলে মাফিয়া বসদের খুশি রাখতে হয়। না হলে তারা দোকান লুট করবে। তালা মারবে দোকানে। লোকজন ভয় পেয়ে চুপ থাকে। শহরটার ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে পৌনে দুই লাখই অভিবাসী। এদের মধ্যে আছে বাংলাদেশি, আফ্রিকান, শ্রীলঙ্কান, ভারতীয় ও চীনারা। অনেক বাংলাদেশি এখানে সস্তা পণ্য ফেরি করেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। অদ্ভুত ঘটনা হলো এই, মাফিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধটা স্থানীয়দের দিক থেকে আসেনি, এসেছিল বাংলাদেশিদের তরফে।”

এর জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাদের। প্রাণনাশের হুমকি থেকে শুরু করে দোকানের তালায় সুপারগ্লু লাগানো, দোকানে হামলা চালানো, লুট ও মারধর চলত। এমনি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি হলেন বাংলাদেশি অভিবাসী মোহাম্মদ মিয়া। বহুবার পুলিশকে জানিয়েও প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে বাধ্য হয়ে স্বদেশিদের সঙ্গে জোট বানিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছেন মোহাম্মদ মিয়া অন্যান্য স্থানীয় বাংলাদেশি অভিবাসীরা। একজন আক্রান্ত হলে সাথে সাথে অন্যরা ছুটে আসতেন। এভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়েছেন তারা।

মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তপুসহ ১০ বাংলাদেশি এবং ১ তিউনিসীয়সহ মোট ১১ জন।

শত বাধা সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি তারা। যার ফল তারা পেলেন গত ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরের শুরুতেই কুখ্যাত গডফাদার সেত্তিমিনো মাইনিওসহ মাফিয়া গ্যাংয়ের ৪৬ জন আটক হয় তপুদের দায়ের করা মামলার আসামী হিসেবে। ২৫ বছর পর মাইনিও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও ১০ বাংলাদেশির সাহসিকতায় তাদের সমূলে উৎপাটন করা হলো।

অন্যদিকে এহেন কুখ্যাত গ্যাং সমূলে আটকের খবরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে আসেন ওই ১০ বাংলাদেশি অভিবাসী। বিশ্বের বুকে আরো উজ্জ্বল করেন বাংলাদেশের পতাকার মর্যাদা।