একটি চমক দরকার কক্সবাজারের রায়হানের!

আজকের পত্রিকা •

২০ বছর আগে জীবনটাই থেমে যেতে পারত! কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও দুই হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই হাত ছাড়াই দীর্ঘ ২০ বছরের পথচলায় নিজেকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। নিয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত। এবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ফলাফলে চমক দেখিয়ে প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছেন! এখন মানুষের সেবায় কাজ করতে চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ছাত্র।

সারা দিন পরিশ্রম করে রাতে পড়ে প্রথম শ্রেণি পাওয়া এ ছাত্রের নাম বাহার উদ্দিন রায়হান। তিনি জিপিএ ৪-এর মধ্যে পেয়েছেন ৩ দশমিক ১৩।

রায়হানের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নে। তাঁর পরিবারে মা ছাড়া আর কেউ নেই। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর এক দুর্ঘটনায় তিনি হারান এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে মা খালেদা বেগম ছেলের জন্য যুদ্ধ করে চলেছেন। পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যায় রায়হানকে। এই সাফল্যে তাই পরিবারের অবদানকে বড় করে দেখেছেন রায়হান। জানিয়েছেন, তাঁর এতটুকু আসার পেছনে নানার বাড়ির অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ, নানার পরিবার তাঁকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কারও সাহায্য নেননি রায়হান। নিজে অর্থনৈতিক কাজকর্ম করার চেষ্টা করেছেন। মায়ের দেখভাল করেছেন। এখন একটি চাকরি পেলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব তাঁর পক্ষে।

পেছনের গল্প বলতে গিয়ে রায়হান জানান, দুর্ঘটনার পর একদিন খালাতো বোনের পরামর্শে মুখ দিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। একটু একটু করে মুখ দিয়ে লিখতে লিখতে আয়ত্ত করে ফেলেন সেটা। সেই থেকে তিনি লেখাপড়ায় ফেরার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হতে শুরু করেন। তারপর আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে আবারও তৃতীয় শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে ভর্তি হন চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। ২০১৪ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ ৩ দশমিক ৪১ পেয়ে এসএসসি পাস করেন রায়হান। তারপর মানবিক বিভাগে ভর্তি হন চকরিয়া কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে প্রতিবন্ধী কোটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন রায়হান। তিনি বলেন, ‘গ্রাম থেকে শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য যখন আসি, তখন মা শুধু একটি কথাই বলতেন, ‘‘রায়হান তুই পারবি’’। মায়ের সেই অনুপ্রেরণাকে নিজের শক্তিতে পরিণত করেছি।’ নগরের নতুন ব্রিজ এলাকায় এক আত্মীয়র বাড়িতে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন রায়হান।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া খুব সুখকর ছিল না। শহর থেকে দুটি গাড়ি বদলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম টেম্পোতে যেতেন নতুন ব্রিজ থেকে দুই কিলোমিটার দূরের বটতলী রেলস্টেশনে, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে উঠতেন। এভাবে ২৫ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করেছেন রায়হান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকেরা তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। এত দূর আসার পেছনে তাঁদের অবদানও কম নয় বলে মনে করেন তিনি।

জীবনে চমক থাকে। কখনো কখনো সে চমকে মানুষ নিজেও চমকিত হয়ে যান। রায়হানের জন্য এখন একটি চাকরি চমকের চেয়েও বেশি কিছু।