কক্সবাজারে দুই হাজার অবৈধ ডাম্পার-পিকআপে অবাধে মাটি-বালু-গাছ পরিবহন

বিশেষ প্রতিবেদক •

 

কক্সবাজারের নয়টি উপজেলার মধ্যে সাতটিতে সড়ক–উপসড়কে প্রায় দুই হাজার অবৈধ ডাম্পার (ছোট ট্রাক) ও পিকআপ চলাচল করে। এসব যানবাহনে সরবরাহ হয় পাহাড় কাটার মাটি, ঝিরি–খাল ও নদী থেকে উত্তোলন করা বালু এবং বনাঞ্চলের গাছ। এতে নদী-খাল, প্রাকৃতিক ঝিরি সংরক্ষিত পাহাড় ও বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে।

বন বিভাগ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলছেন, কক্সবাজারের উখিয়া, রামু, চকরিয়া, সদরের অন্তত ২০-৩০টি পাহাড় ও ৩০টির বেশি প্রাকৃতিক উৎস (নদী, খাল ও ঝিরি) থেকে ডাম্পার ও পিকআপে দৈনিক কয়েক লাখ ঘনফুট মাটি ও বালু পাচার হচ্ছে। বন বিভাগ ও ট্রাফিক পুলিশ অভিযান চালিয়ে একের পর এক ডাম্পার আটকে জরিমানা করলেও পাহাড়নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিআরটিএ কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় ২ হাজার ৪০০টি ডাম্পার (মিনিট্রাক) রয়েছে, যার ১ হাজার ৪৫০টির নিবন্ধন নেই। এ ছাড়া দেড় হাজার পিকআপের মধ্যে নিবন্ধন নেই অন্তত ৫৫০টির।

রাত ১১টার পর থেকে সড়কে ট্রাফিক পুলিশের টহল না থাকার সুযোগে ডাম্পার ও পিকআপে পাহাড় কাটার মাটি ও নদীর বালু পাচার হয় বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, দিনেও কিছু ডাম্পারে মাটি পাচার হয়। ডাম্পারসহ অবৈধ যানবাহন জব্দ হলেও জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, জব্দ গাড়ি রাখার জায়গা নেই।

গত চার মাসে জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বালু ও গাছবোঝাই শতাধিক ডাম্পার ধরে জরিমানা করা হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, জেলার বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজারের বেশি অবৈধ ডাম্পার ও পিকআপ রয়েছে। এসব যানবাহনে রাতের বেলায় চলে পাহাড়নিধন এবং খাল-নদী-ঝিরি থেকে আহরণকৃত বালু পাচারের কাজ। সব অবৈধ ডাম্পার-পিকআপ জব্দ করা গেলে পাহাড়নিধন ও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যেত। তাতে রক্ষা পেত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

সম্প্রতি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী মোছারখোলা, বরতলী, মধুরছড়া, পালংখালী খালের আগাসহ অন্তত ১২টি এলাকা ঘুরে পাহাড় কাটার দৃশ্য চোখে পড়েছে। কয়েকটি এলাকায় একসঙ্গে ১০-১২টি ডাম্পারে বালু বোঝাই করতে দেখা গেছে। এসব বালু কক্সবাজার শহরে নেওয়া হচ্ছিল।

পাহাড়নিধন ও বালু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা। পালংখালী ইউনিয়নে শ্রমিকের কাজ করা রোহিঙ্গা নবী আলম (৪৫) বলেন, আশ্রয়শিবির থেকে এসে তাঁরা ৩০ জন রোহিঙ্গা নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন। দৈনিক মজুরি পান ৩০০ টাকা করে। রোহিঙ্গা মাঝি কামাল তাঁদের নিয়ে এসেছেন। স্থানীয় কারা পাহাড় কাটার কাজে জড়িত, তা তাঁরা জানেন না।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, গত এক মাসে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বাইরে কাজে আসা অন্তত ৮০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বন বিভাগের কর্মীরা জানিয়েছেন, উখিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নে পাহাড় কাটার মাটি ও খালের বালুর পাচারে জড়িত ৭০০টির বেশি অবৈধ ডাম্পার ও পিকআপ রয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও ও চকরিয়ায় রয়েছে আরও ১ হাজার ৩০০টির বেশি অবৈধ ডাম্পার ও পিকআপ। চকরিয়ার রংমহল, মাতামুহুরী নদী, রামুর বাঁকখালী নদী, মরিচ্যা ও খুনিয়াপালং ইউনিয়নের বিভিন্ন খাল থেকে তোলা বালু পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে আরও কয়েক শ ডাম্পার।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের একাধিক পাহাড়ে ড্রেজার মেশিন এবং খাল ও ঝিরিতে পাম্প মেশিন বসিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন হচ্ছে। প্রতিদিন ২০০-২৫০টি ডাম্পারে বালু পাচার হচ্ছে। প্রতি ডাম্পার মাটি ও বালু বিক্রি হয় ৯০০ থেকে ৭ হাজার টাকায়। পাহাড়কাটা মাটি দিয়ে নিচু জমি ভরাট ও ইট তৈরি হয়। খালের বালু ব্যবহৃত হয় পাকা ভবনের দেয়াল ও ছাদঢালাইয়ের কাজে।

কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে ও স্থানীয় একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডাম্পারের চালকদের বেশির ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর। তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। গত মার্চ মাসে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে ২০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সময় দুটি পৃথক ঘটনায় ডাম্পারের চাপায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আমজাদ হোসেন বলেন, ডাম্পারের দৌরাত্ম্য বেশি শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে। রাতে ডাম্পার বোঝাই করে বালু ও মাটি সরবরাহ হয়। গত কয়েক মাসে বালু নিয়ে শহরে ঢোকার সময় ৬০টির বেশি ডাম্পার জব্দ করে ট্রাফিক পুলিশ।

বন বিভাগের তথ্যমতে, গত তিন বছরে উখিয়ায় পাহাড় কাটার ঘটনায় ১২৩ জনের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করে ৯৮টি। কক্সবাজার সদর, রামু ও চকরিয়ায় মামলা হয়েছে আরও ২৩০টির বেশি।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ডিএফও সরওয়ার আলম বলেন, অবৈধ ডাম্পার ও পিকআপের কারণে বনাঞ্চল ও পাহাড় রক্ষা করা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের দিয়ে পাহাড়নিধন হচ্ছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, ডাম্পার ও পিকআপে মাটি ও বালু সরবরাহ চলছে বলেই সংরক্ষিত পাহাড় নিধন, বনাঞ্চল উজাড় ও বালুর ব্যবসা থেমে নেই। হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব ট্রাক ও পিকআপ চলাচল করছে।