কক্সবাজার যেন ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবির না হয়

প্রথম আলো •

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ তরুণ, যাঁরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। বিপুলসংখ্যক কর্মহীন এসব তরুণের জঙ্গিবাদ ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁদের দূরে রাখার বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় শনিবার অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা এই পরামর্শ দেন। স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

রোহিঙ্গাদের ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর ওই রাজ্যে তাদের বসতি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত চার বছরে মিয়ানমার এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যা বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আদি নিবাসে ফিরতে উৎসাহিত করে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। সেই জায়গা থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর অধিকৃত এলাকার ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরগুলো যেমন বিস্ফোরণ্মুখ, সেই পরিস্থিতি যেন কক্সবাজারে না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

ওয়েবিনারে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের কারণে সাময়িকভাবে ভয়ভীতি থাকতে পারে। তবে এর সঙ্গে প্রত্যাবাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, চার বছরে প্রত্যাবাসনে সামান্যতম অগ্রগতি হয়নি। মুহিবুল্লাহ যখন জনসভার আয়োজন করলেন, তখন বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। সঠিক নেতৃত্ব না থাকলে অপরাধীদের হাতে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব চলে যেতে পারে। রোহিঙ্গারা ৬০-৭০ বছরে রাখাইনে থেকে নাগরিকত্ব পায়নি। আর বাংলাদেশে বসে তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার মতো অতি প্রত্যাশাটা ঠিক নয়। কাজেই তাদের নাগরিকত্ব আদায় করতে হবে মিয়ানমারের কাছ থেকে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখতে হবে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা চাইব তারা (রোহিঙ্গা) নিরাপত্তা ও কিছু অধিকার নিয়ে ফিরে যাক। বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা যুবক যে বসে রয়েছেন, তাঁরা শান্ত হয়ে বসে থাকবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বাধ্য না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। চূড়ান্তভাবে এদের অপরাধ ও জঙ্গিবাদে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই রোহিঙ্গা যুবকেরা যাতে এখানে কোনো সমস্যা তৈরি না করেন, সে জন্য তাঁদের কোনো না কোনোভাবে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর আরসার সঙ্গে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের যোগসাজশের সম্ভাবনা রয়েছে।। কাজেই মুহিবুল্লাহ খুনে যদি আরসা কিংবা আল ইয়াকিন জড়িত থাকে, তবে তারা সেটা মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের স্বার্থেই করেছে।’

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন মুহিবুল্লাহ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন–পীড়নের মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত মুখ। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন এবং অধিকার নিয়ে সে দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলে ধরেন তিনি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর শরণার্থীশিবিরে নিজের কার্যালয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

আরও পড়ুন
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা
বিজ্ঞাপন

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মিয়ানমারের গোয়েন্দারা এই অঞ্চলে বিভিন্ন নামে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। কাজেই মহিবুল্লাহ হত্যার মধ্য দিয়ে এটি নিশ্চিত যে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের কক্সবাজারে তৎপরতা রয়েছে। সেটি রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতে পারে। আবার বাইরেও হতে পারে। আবার কক্সবাজারে এত অস্ত্র আসছে, সেটা নিশ্চয় বাইরে থেকে। এটি মাদকের বিনিময়ে ঢুকছে। এত বিপুলসংখ্যক বাহিনী মোতায়েনের পরও সেটি হচ্ছে। আর মাদকের যে ব্যবসা, তাতে লগ্নি আছে বাংলাদেশের লোকজনের। কাজেই কক্সবাজার যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবির না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। কারণ, এটি ঘটলে প্রথম লক্ষ্যবস্তু হবে বাংলাদেশ।

সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমার এখানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হতে দেবে না। তাই মহিবুল্লাহ হত্যার আগে দুই রোহিঙ্গা নেতা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে খুন হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা মহিবুল্লাহকে নেতা বানিয়েছে, তারা তো তাকে সুরক্ষার দায়িত্ব নেয়নি। অথচ উচিত ছিল একজন ব্যক্তির পরিবর্তে সামষ্টিক নেতৃত্ব তৈরি করা। তাহলে হয়তো মিয়ানমার তাঁকে লক্ষ্যবস্তু করত না। মহিবুল্লাহ এতটা ঝুঁকিতে পড়তেন না। অথচ সেটি না হওয়ায় তিনি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন। তাঁকে হত্যার পর এখন তারা হা–হুতাশ করছে। এখন মহিবুল্লাহর মৃত্যু নেতৃত্বের সংঘাত থেকে নাকি মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তৎপরতার যোগসাজশে হলো, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। তবে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বড় পরিসরে চারদিক থেকে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য যা দরকার, সেটা কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়নি। আলোচনা ঘুরেফিরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হয়েছে। প্রথম থেকেই এ প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজ ভূমে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু রাখাইনের যেখানে তাদের বসবাস, তার কোনো চিহ্ন নেই। এই অবস্থায় তারা রাখাইনে গিয়ে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরে থাকার বিষয়টি মেনে নেয়নি। মুহিবুল্লাহ হত্যার মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে ভয়ভীতি ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হতে পারে।

নূর খানের মতে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কিশোর ও যুবক একেবারে নিষ্ক্রিয় বসে আছে। যার সুযোগ নিয়ে তাদের মাদক পাচার ও সন্ত্রাসী সংগঠনে যুক্ত করা হচ্ছে। তাই তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া দরকার। তা না হলে আফগানিস্তানে তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পর এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদের একটি ঢেউ লাগতে পারে।

কক্সবাজারের শিবিরের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কক্সবাজারের এনজিও ফোরামের কো–চেয়ারম্যান আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি জড়িত থাকায় প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে। এ–বিষয়ক আলোচনাও দুই দেশের সরকারের মধ্যে সীমিত। এটিকে দুই দেশের নাগরিক সমাজসহ অন্য স্তরে নেওয়ার বিকল্প ভাবনাটা থাকা উচিত। মুহিবুল্লাহ হত্যার পর পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হলেও সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কে রয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা যুবকের কোনো কাজ না থাকায় তাঁরা মাদক, অস্ত্র পাচারের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে জড়ানোর ঝুঁকি আছে। দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পনা দরকার।

আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজের প্রধান নির্বাহী আমীর খসরু।