মিয়ানমার বেশ কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো একজনকে নেয়নি। নতুন করে তারা ‘পাইলট প্রকল্প’ হাজির করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগের সাফল্য নিয়েও রয়েছে সংশয়।

মিয়ানমারের কৌশল মোকাবিলায় কী করবে বাংলাদেশ

আলতাফ পারভেজ ও লেখা: আশফাক রণি •

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনীতিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে। সেসব তৎপরতার কারণ ও ফলাফল নিয়ে বিস্তর হিসাব-নিকাশও হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক এই সময় মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে? বিশেষ করে যখন রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রায়ই রক্ত ঝরছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রায় ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে।

গত ছয় বছর যা হলো
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের যন্ত্রণার বড় এক উৎস হয়ে আছে মিয়ানমারের রাখাইন (সাবেক আরাকান) সীমান্ত। বেশ কয়েক দফায় এই সীমান্তে দেশকে শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতিটি সংকটের প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী ‘তাতমাডো’ নিয়মিত বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছে। ছয় বছর হতে চলল, বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। কবে নেবে, তারও কোনো রূপরেখা নেই। বাংলাদেশ কীভাবে এদের ফেরত পাঠাবে, সেটাও অস্পষ্ট।

পুরোনো চুক্তিগুলোর কী হলো, আসন্ন সমঝোতার জামিনদার কে থাকছে, সেটাও অস্পষ্ট। এই অবস্থাকে মিয়ানমারের দিক থেকে সচেতন দীর্ঘসূত্রতা কি না, তা নিয়ে কূটনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তবে এই দীর্ঘসূত্রতার আড়ালে মিয়ানমার কী কাজ করেছে, তা বেশ চিন্তার বিষয়।

রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ফলে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ‘ঢেউ’ নামে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ অনেকাংশে চীনের ‍ওপর ভরসা করে। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর সংকট নিরসনে চীনের মধ্যস্থতায় তিন ধাপের কর্মসূচির কথা শোনা যায়।

এই কর্মসূচির প্রথম ধাপে রাখাইনে যুদ্ধবিরতি কায়েম, দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু এবং তৃতীয় ধাপে রাখাইনকে শরণার্থী ফেরানোর উপযোগী করে তোলার কথা বলা হয়েছিল।

এই কর্মসূচির আলোকে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে শরণার্থী ফেরাতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় এবং ১৯ ডিসেম্বর ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমার প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা নেবে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ জন করে ফেরত গেলে শিবিরের সব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রায় ১৫ বছর সময় লাগবে! তবে মিয়ানমার আশ্বস্ত করে বলেছিল, তিন মাস পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রত্যাবাসনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। তারা দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে থাকা সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে।

একদিকে কূটনৈতিক দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে রাখাইনে এসব উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের জন্য হতাশার। স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে দুর্ভাবনা তৈরি হয়েছে—নতুন পাইলট প্রকল্পের আওতায় যত শরণার্থীই রাখাইনে ফিরুক, তাদের কোথায় পুনর্বাসন করা হবে?
এই চুক্তির আওতায় শরণার্থীদের ‘যাচাই’ প্রক্রিয়া মিয়ানমারের করার কথা। অর্থাৎ তাদের সন্তুষ্টির ওপর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নির্ভর করবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২১ সালের ১৫ জুনের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে প্রথমে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ রোহিঙ্গার একটা তালিকা দেয়। এই তালিকা থেকে মিয়ানমার প্রায় ৬২ হাজার রোহিঙ্গাকে যাচাই করে (ডেইলি স্টার, ১১ মার্চ ’২৩)—যা তালিকার মাত্র ৭ শতাংশ। আবার যাচাই করা প্রায় অর্ধেক রোহিঙ্গার অধিকতর যাচাইয়ের প্রয়োজন বলেও জানায় তারা। কিন্তু তখন একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। কারণ, চুক্তিমতো রাখাইনে রোহিঙ্গা ‘প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ’ তৈরি হয়নি। মাঝে ছয় বছর পার হয়ে যাচ্ছে। এখন নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ক্রমেই সন্ত্রাস ঢুকছে। প্রায়ই সেখানে রক্ত ঝরছে।

চীনের ওপর ভরসা
মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সমাজে অচ্ছুত ও নানা অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ গত পাঁচ-ছয় বছর বাংলাদেশ অসংখ্যবার সেখানকার শাসকদের সঙ্গে বসেছে। ২০১৮ সালের জুনে চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হলেও মিয়ানমার কাউকে ফেরত নেয়নি। এরপর ২০১৯ সালে তিন দেশ মিলে ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গড়ে তোলে। ‘প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ’ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেবারও কোনো রোহিঙ্গাকে পাঠানো যায়নি।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় দফায় ত্রিদেশীয় বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জুনের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও কিছু হয়নি। ২০২২ সালে আবারও তিন দেশের বৈঠক ও প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত। পরিণতি একই।

সর্বশেষ গত মার্চে আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার এবার নতুন ‘পাইলট প্রকল্প’ হাজির করেছে। ৬৮ মাস ধরে প্রত্যাবাসনের আলোচনায় সমস্যার সুরাহা না হলেও বাংলাদেশ আবার চীনের কূটনৈতিক প্রভাবের ওপর ভরসা রাখল।

শোনা যাচ্ছে, নতুন পাইলট প্রকল্পে মিয়ানমার ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গা ফেরত নেবে (প্রথম আলো, ৩ মে)। এ জন্য তারা ৭১১ জনের যাচাই প্রক্রিয়া শেষ করেছে। তবে কবে পাইলট প্রকল্পের প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র দেখতে আজ শুক্রবার রাখাইনে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল।

এরই মধ্যে খবর এসেছে, চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেছেন (bnionline.net, ২০ এপ্রিল)। মিয়ানমার কবে নাগাদ রোহিঙ্গাদের যাচাই শেষ করবে, কত দিনে তাদের ফেরত নেবে—সে ব্যাপারে বৈঠকে কোনো রূপরেখা দেওয়া হয়েছে কি না, জানা যায়নি। পুরোনো চুক্তিগুলোর কী হলো, আসন্ন সমঝোতার জামিনদার কে থাকছে, সেটাও অস্পষ্ট। এই অবস্থাকে মিয়ানমারের দিক থেকে সচেতন দীর্ঘসূত্রতা কি না, তা নিয়ে কূটনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তবে এই দীর্ঘসূত্রতার আড়ালে মিয়ানমার কী কাজ করেছে, তা বেশ চিন্তার বিষয়।

রোহিঙ্গা গ্রামগুলো আর তাদের নেই
রাখাইনের রোহিঙ্গা সূত্রগুলো বলছে, তাদের বড় অংশকে তাড়ানোর পর উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৪০০ গ্রামের জনবসতি ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা শুরু হয়। এখনো সেই কাজ চলছে। পাশাপাশি মংডু ও বুচিডং এলাকায় ছয়টি নতুন সেনাক্যাম্প হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘খালি ও অনাবাদি জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ আইন’ সংশোধন করা হয় (২০১৮ সালের ২৪ নম্বর আইন)। সংশোধন অনুসারে, রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া জায়গা ‘যদি ছয় মাসের মধ্যে মালিকানার অনুমতি নেওয়া না হয়, তাহলে সরকারের মালিকানা’য় চলে যাবে। এই অনুমতি চাওয়ার শেষ সময় ছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ।

চলাচলে নিয়ন্ত্রণ থাকায় রাখাইনে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা বা বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ‘অনুমতি’র আবেদন করতে পারেননি। ফলে তাঁদের জমি এখন সেখানকার সরকারের। কেউ মালিকানা অনুমতি ছাড়া এসব জমিতে আশ্রয় নিলে তাকে বের করে দেওয়া হবে বা পাঁচ লাখ কিয়াত পর্যন্ত জরিমানা বা কারাগারে যেতে হবে।

অন্যদিকে মিয়ানমারে অধুনালুপ্ত জাতীয় সংসদের ২০১৩ সালের ৩১ জুলাইয়ের ‘ন্যাচারাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ল’ অনুসারে, পুড়ে যাওয়া অঞ্চল সরকারের জিম্মায় যায়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে যে আগুন দেওয়া হয়, তা একটা সচেতন প্রয়াস ছিল। এসব জমি সরকারের জিম্মায় চলে গেছে। ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে মিয়ানমারের তৎকালীন পুনর্বাসনমন্ত্রী স্পষ্টই জানিয়ে রেখেছেন, সরকার মিয়ানমারের দগ্ধ ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেবে।

একদিকে কূটনৈতিক দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে রাখাইনে এসব উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের জন্য হতাশার। স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে দুর্ভাবনা তৈরি হয়েছে—নতুন পাইলট প্রকল্পের আওতায় যত শরণার্থীই রাখাইনে ফিরুক, তাদের কোথায় পুনর্বাসন করা হবে? রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ও জমি আগের অবস্থায় নেই, আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেই। ফলে তাদের নেওয়া হতে পারে অস্থায়ী শিবিরে। রাখাইনে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি নতুন ও পুরোনো অনেক শিবির আছে। এ ছাড়া ঘুমধুম ইউনিয়নের উল্টো দিকে মংডুর তংব্রোলাকওয়িতে আরও অস্থায়ী আশ্রয়শিবির করা হয়েছে। সেখানে অনেক ‘কনটেইনার শেল্টার’ও রয়েছে।

রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেলেও জমির অধিকার পাওয়ার কথা নয়। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনেরও পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গারা সেখানে অনাগরিক হিসেবেই থাকছে। তাদের ব্যাপারে রাখাইন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন আলোচনায় রাখাইন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে আরাকান আর্মিসহ অনেক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে।

আবার রোহিঙ্গাবিরোধী জনমত ও রোহিঙ্গা বিরোধিতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর উৎসাহ আছে এসবে। তাতে পুরো প্রদেশকে দুটো স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত রেখে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এসব বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞরা।

তাতমাডোর সামনে দুই চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমারে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোও বাংলাদেশের জন্য একটা সাফল্য। কারণ, এ সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ক্লান্ত। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য এটা এখন আরও বেশি জরুরি। গণতন্ত্রপন্থীদের স্তব্ধ করতে গিয়ে তারা মিয়ানমারকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। এখন আন্তর্জাতিক সমাজে মুখরক্ষার জন্য মানবিক কিছু খবর দরকার। বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। তবে এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন ‘আইসিজে’ নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে দেখানো যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু হয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে গাম্বিয়া আইসিজেতে ওই মামলা করে। মামলায় মিয়ানমারের শাসক-জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের জবাব দেওয়ার যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন আদালত, সেটা এ মাসে শেষ হবে। মিন অং হ্লাইয়ের সরকার সময়সীমা ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করলেও সেটা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মিয়ানমারের জন্য আইসিজের এই ক্ষণটা খুব উৎকণ্ঠার। তাই এখন তাদের দিক থেকে রোহিঙ্গাবান্ধব একটা খবর দরকার। কূটনীতিক অঙ্গনে দু-একটি বন্ধুরাষ্ট্রও তাদের সাহায্য করতে উদ্যোগী বলে মনে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিবাচক কিছু দেখানো আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্যও জরুরি হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০ দেশের এই জোটে মিয়ানমারও আছে। আগামী মাসে ইন্দোনেশিয়ায় আসিয়ানের ৪২তম সম্মেলন বসছে।

রোহিঙ্গাদের দমনপীড়ন রোধে আসিয়ান কখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থীদের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে কিছু করার জন্য এই জোটের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ পড়ে। এ নিয়ে আসিয়ানে বিভক্তিও চলছে। কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মিয়ানমারের জেনারেলদের পক্ষে। আবার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া জেনারেলদের জবাবদিহির আওতায় আনার পক্ষে। মিয়ানমারে রক্তাক্ত সহিংসতা ক্রমে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবিকে জোরালো করছে। এ অবস্থায় চীন চাইছে আসিয়ান জোট সক্রিয়
হয়ে এ অঞ্চলে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’-এর সুযোগ নস্যাৎ করুক।

কিন্তু আসিয়ানকে সক্রিয় হতে হলে মিয়ানমারের শাসকদের এমন কিছু ‘ভালো কাজ’ করতে হবে, যাতে তাদের পক্ষ নিয়ে দু-চার কথা বলা যায়। রোহিঙ্গা বিষয়ে ‘ত্রিদেশীয়’ তৎপরতায় আসিয়ানের প্রত্যাশার পরোক্ষ ছাপ থাকতে পারে। কিন্তু এসব উদ্যোগের উদ্যোক্তারা রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারকে কতটা চাপ দিচ্ছে, সেটাই এ সময়ের তিক্ত এক প্রশ্ন। তা ছাড়া রাখাইন সীমান্তে মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগমূলক যেসব সামরিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, সেগুলোও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আমলে নেওয়া জরুরি।

মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের অজুহাতে সম্প্রতি বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং সীমান্তের এপারে মর্টার ছুড়েছে। তাতমাডোর সামরিক চরিত্র ও মিয়ানমারের সমাজজীবনে বাংলাদেশ বৈরিতা সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মানতে চান না। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তে প্রতিবেশীর বাড়তি সামরিক উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। অন্তত দুটি বড় দেশ যেভাবে মিয়ানমারকে অস্ত্রসজ্জিত করছে, তা-ও অবজ্ঞা করার মতো নয়।

এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কীভাবে জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের কলাকৌশল মোকাবিলা করবে? কিংবা রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ তার পুরোনো কৌশলকে নতুন করে ঢেলে সাজাবে কি না? ইতিমধ্যে যে প্রায় ছয়টি বছর পার হতে চলল!

লেখকদ্বয়: গবেষক