গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন : মুহিবুল্লাহ হত্যা ‘৭ কারণে’

নাজিম মুহাম্মদ •


সাত কারণে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বেশ কয়েকজনের নামও প্রকাশ করেছেন নিহত মহিবুল্লার ভাই হাবিবুল্লাহ। তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পার হলেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয় নিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এণ্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতেন মহিবুল্লাহ।

টেকনাফ-উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একই মতাদর্শের আরো ১১টি সংগঠন রয়েছে। মহিবুল্লাহ হত্যার পর এসব সংগঠনের নেতারাও শংকিত হয়ে পড়েছেন। হত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা, ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর প্রতি নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহিবুল্লাহ একজন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থী। তার বাবার নাম মৃত ফজল আহম্মেদ। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু টাউনশিপের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করতেন।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একজন গ্রহণযোগ্য নেতার অভাব ছিল। গত কয়েকবছর ধরে সে অভাব পুরণ করছিলেন মহিবুল্লাহ। তার ভেতরে মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা ছিল প্রবল। আরাকানের মূল সমস্যা, রোহিঙ্গাদের জাতিগত সমস্যা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়গুলো রোহিঙ্গাদের মাঝে বুঝিয়ে বলতে পারতেন মহিবুল্লাহ।

তিনি ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সভা এবং জেনেভায় জাতিসংঘের সভায় বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এছাড়াও তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর আলোচনায় আসেন মহিবুল্লাহ।

প্রতিবেদনে মহিবুল্লার বিস্তারিত পরিচয়, মামলার বর্ণনা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে সংগঠন, মহিবুল্লার মৃত্যুতে বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিকদের বিবৃতি, রোহিঙ্গাদের নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করা ২৮ সংগঠন, মহিবুল্লার ভাইয়ের বক্তব্য ও মহিবুল্লাহ হত্যার সম্ভাব্য সাতটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

মহিবুল্লার ভাই হাবিবুল্লাহ তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (এআরএসএ) বা আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেন। হাবিব উল্লাহ বলেন, এ দুটি সন্ত্রাসী সংগঠনের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে মহিবুল্লাহকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। যারা হত্যায় অংশ নিয়েছে তাদের বেশ কয়েকজন তার পরিচিত মুখ।

যেমন আরসা নেতা আবদুর রহিম লালু ও মুরশিদ হত্যার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নাইমুল হক জানান, মহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত থাকা সন্দেহে আমরা পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি।

হত্যায় জড়িত রয়েছে এমন কারো নাম প্রকাশ করলে তো সে এলাকায় থাকবে না। আমরা চেষ্টা করছি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে।

৭ কারণে মহিবুল্লাহ হত্যা
প্রতিবেদনে মহিবুল্লাহ হত্যার সাতটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

১) আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এণ্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) দায়িত্ব পালনকালে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এলাকার বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য,

২) রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার,

৩) আরাকান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সরাসরি হস্তক্ষেপ,

৪) আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে মহিবুল্লার ব্যাপক জনপ্রিয়তা,

৫) মিয়ানমার সরকার কর্তৃক মহিবুল্লাহ বিরোধী সংগঠনগুলোকে ইন্ধন,

৬ ) দেশি-বিদেশি এনজিও গোষ্ঠীর চক্রান্ত এবং

৭) ক্যাম্পগুলোতে মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের অন্তঃকোন্দল।

শংকায় ১১ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সংগঠন
এআরএসপিএইচের ব্যানারে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয় নিয়ে কাজ করতেন মহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। একই মতাদর্শের আরো ১০টি সংগঠন রয়েছে উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। মহিবুল্লাহ হত্যার পর এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরাও শংকায় রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

১১ সংগঠন হলো- আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এণ্ড হিউম্যান রাইটস, চ্যাম্পিয়নস অব চেঞ্জ, এডুকেশন এণ্ড উইজডম ডেভেলপমেন্ট ফর রোহিঙ্গা উইম্যান, রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি, রোহিঙ্গা উইম্যান এডুকেশন ইনিশিয়েটিভ, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফর লিগ্যাল একশন, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ইউনিটি টিম, ভয়েজ অব রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন ও রোহিঙ্গা উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট এণ্ড এডভোকেসি নেটওয়ার্ক।

প্রবাসী ২৮ রোহিঙ্গা সংগঠনের বিবৃতি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহিবুল্লাহ হত্যার বিচার চেয়ে পৃথিবী বিভিন্ন দেশের ২৮ রোহিঙ্গা সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে।

এসব সংগঠনের নেতারা বলেন,মহিবুল্লাহ ছিলেন একজন বড় মাপের শরণার্থী নেতা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা ও সুস্থতার জন্য কাজ করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্ব নেতাদের সাথে শরণার্থীদের কন্ঠস্বর এবং উদ্বেগ উত্থাপন করেছিলেন।

বিবৃতিদাতা সংগঠনগুলো হলো আরাকান রোহিঙ্গা উন্নয়ন সমিতি অস্ট্রেলিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা জাতীয় সংস্থা, অস্ট্রেলিয়া বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, যুক্তরাজ্য ব্রিটিশ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়, কুইসল্যাণ্ড-অস্ট্রেলিয়া বার্মিজ রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন, বার্মিজ রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন জাপান, বার্মিজ রোহিঙ্গা কমিউনিটি অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক বার্মিজ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়, বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে, কানাডিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থা, কানাডিয়ান রোহিঙ্গা উন্নয়ন উদ্যোগ, ইউরোপীয় রোহিঙ্গা কাউন্সিল, ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন (এফআরসি), লস এঞ্জেলেস রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন, মালয়েশিয়া মিয়ানমার জাতিগত রোহিঙ্গা মানবাধিকার সংস্থা, রোহিঙ্গা একশন আয়ারল্যাণ্ড, রোহিঙ্গা আমেরিকান সোসাইটি, নরওয়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়, নেদারল্যাণ্ড রোহিঙ্গা সম্প্রদায়, রোহিঙ্গা সংস্কৃতি কেন্দ্র শিকাগো, রোহিঙ্গা মানবাধিকার উদ্যোগ, রোহিঙ্গা মানবাধিকার নেটওয়ার্ক-কানাডা, রোহিঙ্গা শরণার্থী নেটওয়ার্ক, রোহিঙ্গা সোসাইটি মালয়েশিয়া, রোহিঙ্গা সংস্থা নরওয়ে, রোহিঙ্গা নারী উন্নয়ন নেটওয়ার্ক ও সুইডিশ রোহিঙ্গা এসোসিয়েশন।