২০ জনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে

মাদকের টাকায় অস্ত্র, সক্রিয় আরসার অর্ধশতাধিক সদস্য

ঋত্বিক নয়ন •

ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফ, তুমব্রু, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান সীমান্তে মাদক কারবার থামছে না। আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) তৎপরতার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘিরে খুনোখুনি বাড়ছে। আছে আল সাবা ও আল ইয়াকিনের দৌরাত্ম্যও। অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে ইয়াবা ও আইস বিক্রির টাকায় কেনা হচ্ছে ভারী অস্ত্র। কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আরসা সদস্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে মাদক কারবারে সক্রিয়। এদের ২০ জনের ব্যাপারে পুলিশের একটি ইউনিটের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক চোরাচালানের অবস্থা সবসময় থাকে না। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে মাদক পাচারের চেষ্টা করে। আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অস্ত্র কেনার অর্থের যোগান দিতেও মাদকের চালান আনা হয়। এককভাবে মাদকের চোরাচালান করা সম্ভব নয়। কোনো গোষ্ঠীর মাধ্যমে এটি করা হয়। সেই গোষ্ঠীর খোঁজে সক্রিয় র‌্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ। তাদের অভিমত, মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আনতে উগ্র রোহিঙ্গাদের জড়িত হতে দেখা গেছে বেশি। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের চোরাকারবারিরাও জড়িত।

গোয়েন্দা সূত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে অর্ধশতাধিক ছোট–বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। প্রতিটি বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। ক্যাম্পে অধিক পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে মাস্টার

মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপ, মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, মৌলভী আনাস গ্রুপ, কেফায়েত, জাবু গ্রুপ, আবু শমা গ্রুপ, লেড়াইয়া গ্রুপ, খালেদ গ্রুপ, শাহ আজম গ্রুপ, ইব্রাহিম গ্রুপ ও খলিল গ্রুপ।

এসব গ্রুপে আছেন আবদুল জব্বার, নুরুল আমিন, শাহ আলম, মো. কেফায়েত, নুরুন নবী, আবদুল হাকিম, সুলতান, জকির আলম, মো. আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুক্কুর, শরীফ হোসেন, মো. রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, মো. সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবুর রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসান শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত। এদের মধ্যে আরসা, আল সাবা, আল ইয়াকিনসহ একাধিক সস্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। তাদের মূল ব্যবসা ইয়াবা ও অস্ত্র। প্রতিদিন লাখ লাখ পিস ইয়াবার চালান নানা কায়দায় এদেশে ঢুকে হাতবদল হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, নবী হোসেন, মাস্টার মুন্না গ্রুপসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিক্তিক বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা মনে করছেন, মূলত বিশ্বের কাছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলা রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া ভিন্নখাতে প্রভাবিত করা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে আরসাকে মদদ দিচ্ছে মিয়ানমার। একটি সূত্রের দাবি, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরসা চাপে পড়লেও তারা আরো অস্ত্র সংগ্রহ করে অস্থিরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

এদিকে মাদক বিক্রির টাকায় অস্ত্র সংগ্রহ করছে আরসা গোষ্ঠীসহ ক্যাম্পের অন্য গ্রুপগুলো। এসব সংগঠনের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনী একাধিক প্রমাণ পেয়েছে। একইসঙ্গে এসব অস্ত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কঙবাজারে অপহরণ, হত্যাসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে তারা। এ সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অস্ত্রের উৎস অনুসন্ধানে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল ভোরে কঙবাজারের উখিয়া সীমান্ত এলাকার একটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ২১ কেজি ৯০ গ্রাম ওজনের ক্রিস্টাল মেথ (আইস) উদ্ধার করে ৩৪ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন (বিজিবি) সদস্যরা। এ সময় তিনজনকে আটক করা হয়। দেশে ক্রিস্টাল মেথের এত বড় চালান আর কখনও ধরা পড়েনি বলে জানান ৩৪ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির। তিনি জানান, এই বিশাল অংকের আইসের চালানটি পাচার হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিল।

এর আগে ৭ এপ্রিল বাহাড়ছড়া এলাকা থেকে র‌্যাব–১৫ এর একটি বিশেষ অভিযান টিম টেকনাফের নয়াপাড়া মোছনি ১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি–ব্লকের বাসিন্দা আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। র‌্যাব–১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, আরিফ দীর্ঘদিন ধরে মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র কিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সন্ত্রাসীদের কাছে সরবরাহ করছিল। গ্রেপ্তারের সময় তার থেকে ৪টি শুটারগান, ৩ রাউন্ড কার্তুজ ও দুটি অটো স্নাইপার রাইফেলের গুলি উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, অস্ত্রের উৎসের ব্যাপারে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত বড় কোনো অস্ত্রের চালানের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে যে আসবে না এ আশঙ্কা আমরা ফেলে দিতে পারছি না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থান থেকে ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত বিভিন্ন পরিমাণ ইয়াবা জব্দ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এখন এক অপরাধের টাকা আরেকটা অপরাধে খরচ করছে। ফলে অনেকাংশে মাদক বিক্রির টাকা অবৈধ অস্ত্র কেনার কাজে ব্যবহার করছে তারা। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তালিকা করা হয়েছে। আরও চিহ্নিত করার পাশাপাশি তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

৬ এপ্রিল চকরিয়া থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহকারী মূল হোতাসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ৪টি অস্ত্র ও অস্ত্র বিক্রির নগদ টাকা।

জানা যায়, প্রতিটি ক্যাম্পে আরসা ক্যাডারদের অস্ত্র তুলে দিতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা কমান্ডাররা ক্যাম্পের পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানা করেছিল। এর আগে কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের পাশের পাহাড় থেকে র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দা অস্ত্র তৈরির এক কারিগরসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। উদ্ধার করা হয়েছিল চারটি অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম।

• আআআ/সিবিজে/ আজাদী