কক্সবাজার সীমান্ত এলাকা দিয়ে যে কারণে বেড়েছে ভয়ংকর মাদক ‘আইস’র চালান

বিশেষ প্রতিবেদক :

ইয়াবার চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষতিকর আইসের বাজার এখন পুরোপুরি চাঙ্গা। বলতে গেলে ইয়াবার বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে আইস। ব্যয়বহুল এই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন দেশের সম্পদশালী ঘরের সন্তানেরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মাদকাসক্তরাও এখন ইয়াবা ছেড়ে আইসে ঝুঁকছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের সঙ্গে বাংলাদেশি কারবারিরা যোগাযোগ করে দেশে আইস নিয়ে আসছে। কিছুদিন আগেও যেসব রুটে ইয়াবার চালান আসতো এখন সেসব রুট দিয়েই আসে আইস। মাঝে-মধ্যে কিছু চালান ধরা পড়লেও বড় বড় চালানগুলো কৌশলে সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আনা এসব আইসের চালান ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে।

জানা যায়,গত বছর কক্সবাজার সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ৭৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ বা আইস জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

তবে চলতি বছরের গত ২৬ এপ্রিল উখিয়া সীমান্তে এক চালানেই জব্দ হয় ২১ কেজি আইস! এর আগের দিন টেকনাফ সীমান্তে জব্দ করা হয় এক কেজি আইস।

অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসে এই দুটি সীমান্তে মাত্র ৩ কেজি ১৯২ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়েছিল।

এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে ভয়ংকর ওই মাদকের চাহিদা কতটা বেড়েছে। অথচ ৫ বছর আগে দেশে প্রথমবারের মতো মাত্র পাঁচ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার করা হয়।

ঢাকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই অভিযানের পর নতুন এই মাদক নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সেই তোলপাড়ে ভাটা পড়লেও থেমে থাকেনি এর পাচার ও ব্যবহার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের অতি উচ্চমূল্যের কারণে মূলত এটা ‘হাইসোসাইটির’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত। দেশের অভ্যন্তরে মাদকসেবীদের কাছে চাহিদা থাকলে পাচার হয়ে দেশে বেশি ঢুকবে, এটা স্বাভাবিক।

কিন্তু এত বড় চালান জব্দের পর চিন্তায় ফেলেছে সবাইকে। দেশের অভ্যন্তরে এই ভয়ংকর মাদকের এতটা চাহিদা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ক্রিস্টাল মেথ পাচারে বাংলাদেশ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, ‘ডিমান্ড বাড়লে সাপ্লাই বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। তা ছাড়া নতুন মাদক হিসেবে এর মুনাফা বেশি পায় কারবারিরা, এর চাহিদাও থাকে বেশি। এজন্য কারবারিরাও ঝুঁকে পড়ে। এতে পাচারও বেড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘তাদের কাছে থাকা তথ্যানুযায়ী ক্রিস্টাল মেথ বা আইস হাইসোসাইটির ড্রাগ। সেই সংখ্যাটা কম হওয়ার কথা। কিন্তু উখিয়া সীমান্তে এক চালানেই ২১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ জব্দের পর বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছে। এই মাদক পাচারে বাংলাদেশ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেই তদন্তও করা হবে এখন। এজন্য বড় চালানসহ ধরা পরা তিনজনের বিষয়ে নজরদারি শুরু হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে দেশে ক্রিস্টাল মেথের অস্তিত্ব পাওয়ার পর এতদিনে এই মাদকে আসক্ত ব্যক্তি কারা বা এর সেবী সংখ্যা কত—সেই পরিসংখ্যানও নেই। এতে নিশ্চিত করে বোঝাও যাচ্ছে না যে, দেশের মাদকসেবীরাই এটা ব্যবহার করছে নাকি অন্য কোথাও পাচার হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. শোয়েবুর রেজা চৌধুরী বলেন, দেশে ক্রিস্টাল মেথে কতজন আসক্ত, অফিসিয়ালি সেই স্ট্যাডি বা পরিসংখ্যান নেই। তা ছাড়া এ ধরনের আসক্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিতে এসেছেন বলেও তার জানা নেই।

অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন বিভাগ সূত্র বলছে, ক্রিস্টাল মেথে সাধারণত উচ্চবিত্তের সন্তানরা আসক্ত। এরা এই মাদক নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে সাধারণত আসে না। বিদেশে বা দেশের বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। এজন্য এ ধরনের মাদকাসক্তদের কোনো পরিসংখ্যান নেই।

দেশে এ পর্যন্ত সর্ববৃহৎ ২১ কেজি ৯০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধারে অভিযান চালায় বিজিবির রামু ব্যাটালিয়ন। ওই অভিযানে রুজুরুছ মিয়া, ছৈয়দুল বাশার ও মো. ইসমাইল নামে তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

বিজিবির কক্সবাজারের রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মেহেদি হোসাইন কবির বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই তালিকাভুক্ত মাদককারবারি রুজুরুছ মিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে উখিয়া উপজেলার পালংখালীতে অভিযান চালানো হয়।

বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে পাচারকারীরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ধাওয়া করে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তাদের ফেলে দেওয়া বস্তা তল্লাশি করে ২১ কেজি ৯০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করা হয়।

সেক্টর কমান্ডার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানতে পেরেছেন, ক্রিস্টাল মেথের এই বড় চালান উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেখান থেকে তা বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করার কথা। ওই ঘটনায় মামলা করে তিন পাচারকারীকে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বিস্তারিত তদন্তে বের হবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্রিস্টাল মেথের বড় চালান জব্দের ঘটনায় দায়ের মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। এই চালান রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কোথায় যেত, তা তদন্ত করা হচ্ছে। এজন্য তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (চট্টগ্রাম বিভাগ) পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, পুলিশের তদন্তে ক্রিস্টাল মেথের এই বড় চালান সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বের হবে। পুরো ঘটনার ওপর তারা নজর রাখছেন। বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার তিনজনের বিরুদ্ধে আগে কোনো মাদকের মামলা ছিল কি না বা এদের নেপথ্যে কারা, সব বিষয়ে তারা নজরদারি করছেন।