দুদকের তদন্ত সামাল দিতে উখিয়ার হলদিয়ায় ৭ মাস পর কার্ড বিলির হিড়িক

বিশেষ প্রতিনিধি •


কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ৩ নম্বর হলদিয়া পালং ইউনিয়নের বিতর্কিত চেয়ারম্যান এস.এম ইমরুল কায়েস চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের তদন্ত শুরুর প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে ভিজিডির কার্ড বিতরণ করার কাজ শুরু হয়েছে।

গত দুইতিন দিন ধরে পুরো ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মেম্বার-চেয়ারম্যানের ঘুম হারাম হয়ে গেছে এতদিনের আকাম-কুকাম ধামা চাপা দিতে।

ইউনিয়নের হতদরিদ্র মহিলাদের জন্য দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের চালের ভিজিডি কার্ডগুলো যেখানে অন্যান্য ইউনিয়নে গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বিলি বন্টন করা হয়েছে সেগুলো গত ৭ মাস পর দুদকের তদন্ত শুরু হবার পর পরই অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে বিলি করা হচ্ছে।

এতদিন যেসব মহিলাদের কার্ড না দিয়ে নিজেরা ভাগ- বাটোয়ারা করে নেয়ার তদন্ত শুরু হয়েছে সেই কার্ডগুলো চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মিলে ওয়ার্ডের ওয়ার্ডের ভিজিডির চাল বঞ্চিত মহিলাদের ডেকে কার্ডগুলো দেওয়া হচ্ছে।

তাও কার্ড দেয়ার সময় গত ৭ মাসের চাল বিলি না করে নিজেরা বিক্রি করে খেয়ে ফেলা চাল পেয়েছে মর্মে টিপসহি আদায়ের পরই কার্ডগুলো দেওয়া হচ্ছে।

গত ৭ মাস ধরে অসহায় মহিলারা ভিজিডির চাল না পেয়েও মেম্বারদের কুটকৌশলের ফাঁদে পড়ে সহজ-সরল মহিলাদের টিপসহি আদায় করা হচ্ছে। দুদকের তদন্তে যাতে এতদিন ধরে গরিবের চাল মেরে খেয়ে ফেলার বিষয়টি ধরা না পড়ে সেজন্য চেয়ারম্যান-মেম্বারদের এখন ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

রাতদিন তারা পুরো ইউনিয়নের পাড়ায় পাড়ায় ছুটছে এতদিনের প্রধানমন্ত্রীর উপহার বঞ্চিত মহিলাদের খোঁজাখুঁজির কাজে। এতদিনের হক বঞ্চিত মহিলাদের যাকে যেভাবে পারে সেভাবেই রাজি করানো হচ্ছে যাতে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের সময় চাল পায়নি না বলার জন্য।

গতকাল শনিবার ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভী পাড়ার আলী উদ্দিনের ছেলে নুরুল হাকিমকে দিয়ে ৭০ জনকে কার্ড ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। তাদের নিকট থেকে আগের ৭ মাসের ফরমে ৭টি টিপসহিও আদায় করা হয়েছে।

গ্রামের সহজ-সরল নারীরা দুদকের তদন্তের ওসিলায় তাদের ভিজিডির কার্ড ফেরৎ পাবার কথা জানেনা।

তাদের বলা হচ্ছে, সেইসব ভিজিডি কার্ডরে অনুকুলে এতদিন ধরে চাল বরাদ্দ না হওয়ায দেয়া হয়নি। এখন চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে এতকাল পর নতুন করে চাল বরাদ্দ নিয়ে মানবিক কারণে মহিলাদের দেয়ার কথা
জানাচ্ছেন।

ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে গতকাল চৌধুরী পাড়া চেয়ারম্যান বাড়িতে শতাধিক মহিলাদের কার্ড বিলি করা হয়েছে। এসব কার্ড এতদিন ধরে না দিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই দুদকের তদন্ত সামাল দিতে হলদিয়ার চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নিজের হেফাজতে রেখে যাই করার তাই করার অভিযোগ তদন্তের নির্দেশনা দিয়ে দুদকের প্রধান অফিস।

অপরদিকে এক নম্বর ওয়ার্ডের মরিচ্যার এম মঞ্জুরের তত্বাবধানে ১০০ জন মহিলাদের কার্ডও গতকাল ফেরৎ দেওয়া হয়েছে।

খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৩০ কেজি করে অসহায় দরিদ্র
নারীদের রিজিকের চাল নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ৩ নম্বর হলদিয়াপালং ইউনিয়নের দুঃস্থ নারীদের এতদিন ধরে দেয়া হয়নি।

হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ভিজিডির চাল কেলেংকারির বিষয়টি এমনই যেনে ভয়ংকার রুপ নিয়েছে যে, একজন ইউপি মেম্বারের পাগলিরবিল গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে বিবাহিত ৪ বোনের নামেও চাল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এমনকি প্রবাসে থাকা বোনও রয়েছে ভিজিডি কার্ডধারি।

গতকাল ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারী জানিয়েছেন, তার নামে কার্ড আছে এবং তার কার্ডের অনুকুলে ৩০ কেজি করে চাল আসে তিনি সবই জানেন। কিন্তু তাকে এতকাল ধরে চাল দেয়া হয়নি। এমনকি কার্ডটিও দেয়া হয়নি।

প্রসঙ্গত হলদিয়া ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে হতদরিদ্র মহিলাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের চাল ও কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তদন্তের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

গত জুন মাসে কক্সবাজার পৌরসভার অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনী সভায় ২০১৯ সালে অনুষ্টিত কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ এর অনুষ্ঠিত ইভিএম পদ্ধতির নির্বাচনে পৌর এলাকার ৮ টি ভোট কেন্দ্রের ব্যালট ডাকাতির কথা অত্যন্ত গর্বের সাথে স্বীকার করেছিলেন উক্ত ইউপি চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্যের ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি করে। সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের ইভিএম পদ্ধতির নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও উঠে নানা কথা।

এ কারণে তাৎক্ষনিক বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন উক্ত ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করে।

কমিশনের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ইতিমধ্যে উক্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশনা
প্রদান করে জেলা প্রশাসককে। জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে চেয়ারম্যানকে তার দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে কারন দর্শাও নোটিশও প্রদান করা হয়। সেই প্রতিবেদনও জেলা প্রশাসন থেকে প্রেরণ করা হয়েছে।

ইভিএম পদ্ধতির ভোট ডাকাতির বিষয়টির চুড়ান্ত ফয়সালা হতে না হতেই এবার ইউনিয়নের হতদরিদ্র মহিলাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া চাল ও কর্মসৃজন প্রকল্পের বরাদ্দ দেয়া দরিদ্র শ্রমিকের নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তের নির্দেশনা দেয়া হল। তবে হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব এস.এম ইমরুল কায়েস চৌধুরী ভোট ডাকাতির ভাইরাল হওয়া ভিডিও বক্তব্যটি তার প্রতিপক্ষের মিথ্যা এডিট করা ভিডিও বলে দাবি করে আসছেন।

সেই সাথে হতদরিদ্র নারী ও দরিদ শ্রমিকের ঢাল-ঢাকা আত্মসাতের বিষয়টি ইউনিয়নের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্ধি প্রতিপক্ষের মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ বলেও বার বার জানিয়ে আসছেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর সীমান্ত উপজেলা উখিয়া এবং টেকনাফের জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। উপজেলা দু’টির মানুষের দুর্গতি থেকে রক্ষার জন্য তদানীন্তন মন্ত্রীপরিষদ সচিব শহীদ পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ সফিউল আলম ও সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ঐকান্তিক চেষ্টায় উখিয়া ও টেকনাফের জন্য ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত চাল প্রধানমন্ত্রী বরাদ্দের নির্দেশ প্রদান করেন।

প্রধানমন্ত্রীর উক্ত উপহারের মধ্যে হলদিয়া পালং ইউনিয়নের জন্য রয়েছে ৫ হাজার মেট্রিক টন চাল।

দুদক প্রধান কার্যালয়ে প্রদত্ত হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ভুক্তভোগি বাসিন্দারা লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, উক্ত ইউনিয়নের ৫ হাজার দরিদ্র নারীদের মধ্যে শত শত নারীর কার্ডও এতদিন আটকিয়ে রেখে তাদের চাল নিজেরা বিক্রি করে আত্মসাৎ করেন।

অপরদিকে ২০২২-২০২৩ অর্থ সালে হলদিয়া ইউনিয়নের দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসুচির (ইজিপিপি) বরাদ্দ করা টাকাও ভুয়া শ্রমিক নিয়োগ দেখিয়ে বিকাশ এজেন্টের সাথে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ইউপি মেম্বারদের যোগসাজসে বিপুল অংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে।

উল্লেখ করা হয় যে, হলদিয়ায় এক হাজার ১৮৩ জন শ্রমিকের তালিকা অনুমোদন রয়েছে। এসব শ্রমিকের দৈনিক মজুরি হচ্ছে ৪০০ টাকা। এসব শ্রমিকের জন্য প্রথম কিস্তিতে ১০৮ দিনের সরকারি বরাদ্দ হচ্ছে ৫ কোটি ১১ লক্ষ ৫ হাজার ৬০০ টাকা। এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে দুদকের কক্সবাজারের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মো মনিরুল ইসলামের গত ১০ সেপ্টেম্বরের স্বাক্ষরিত চিঠিতে উপ সহকারি পরিচালক জনাব পার্থ চন্দ্র পালকে তদন্তকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।

চিঠিতে দুদক বিধিমালা ২০০৭ (সংশোধিত ২০১৯) অনুস্মরণ পূর্বক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশনা প্রদান করা হয়।