সাত বছরে ক্যাম্প ছেড়েছে কত রোহিঙ্গা?

উদিসা ইসলাম, বাংলা ট্রিবিউন :

কক্সবাজারে আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোজ ৯৫টি শিশু জন্ম নিচ্ছে, অথচ মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা কমছে। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্য থেকে কিছু মানুষ ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলে তা দৃশ্যমান হয় না বিধায়, গত সাত বছরে ঠিক কত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায় না। নিয়মিত নিবন্ধন মনিটরিং, কাঁটাতারের বেড়া থাকার পরেও ক্যাম্পগুলো থেকে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ পালিয়ে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যাওয়ার অভিযোগ মিলেছে। এতে করে কক্সবাজারে ভয়াবহ সামাজিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বলে দাবি স্থানীয় অধিকারকর্মীদের।

মিয়ানমারে সামরিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিদিন প্রায় ৯৫টি শিশুর জন্ম হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ লাখ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

সেই হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে যদিও ইউএনএইচসিআর-এর হিসাব বলছে, ক্যাম্পে বর্তমানে ২ লক্ষাধিক পরিবারের ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ শতাংশ বৃদ্ধ।

রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে আসা শিবিরে আশ্রিতদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আনা রোহিঙ্গার সংখ্যা রয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। অথচ বর্তমানে ক্যাম্পে রোহিঙ্গার হদিস মিলছে ৯ লাখ ৭৯ হাজার। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে।

গত সাত বছর আগে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের নিয়ে গল্পের যেন শেষ নেই। কেউ বলে, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গারা সাধারণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেউ বলে কিছু টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্মনিবন্ধন পাচ্ছে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে পাসপোর্ট পেয়ে যাওয়ার খবরও আছে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, একটা এলাকায় এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘিরে রাখলেই তারা সেখানে বছরের পর বছর থাকবেন, এমন নাও হতে পারে। স্থানীয়দের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে স্বাভাবিক জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করাটা স্বাভাবিক। তবে সরকারি শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার না করে বলছে— খুব বড় সংখ্যক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়েছেন, এমন না।

রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে উল্লেখ করে ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের’ সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনও ইশারা দেখি না। তারা যেভাবে ক্যাম্পের বাইরে এসে মিশে যাচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। এর মধ্যে আরও অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে দেশে ঢুকেছে। তারা বেশিরভাগ ক্যাম্পে ঢোকেনি। বর্তমান সরকার যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে হয়তো নতুন কিছু হবে।

প্রতি দিন ৯৫টি শিশু জন্ম নিলেও রোহিঙ্গা সংখ্যা কমছে কীভাবে প্রশ্নে মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে তারা বুঝতে শুরু করেছে যে, এখানে তাদের কোনও ভবিষ্যত নেই। ফলে তারা তৃতীয় কোনও জায়গায় আশ্রয় নিয়ে চলে যেতে চায়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে তারা চলে যাচ্ছে। শীত মৌসুমে সমুদ্র ঠান্ডা থাকে বলে সমুদ্র পথে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে তারা ব্যবহার করে।’ করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জোর করে ফেরত পাঠানোর সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’ বাংলাদেশ তাদের উপযুক্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা জাতিকে শিক্ষায় পঙ্গু করে রাখার অপরাধে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে এক সময়।’

রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কমছে কীভাবে প্রশ্নে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন-বিষয়ক অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দৌজা নয়ন বলেন, ‘সংখ্যা কমছে না। শুরুতে যখন তারা আসে তখন একেকজন একাধিকবার নিবন্ধিত হয়েছিল। এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে বছরের পর বছর এভাবে রাখতে হলে নিবন্ধন চলমান থাকতে হবে। পরে ইউএনএইচসিআর তালিকা তৈরির কাজটা করেছে।’ রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেছে বলে যে অভিযোগ করা হয়, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু ঘটেনি। নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের দিকে কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢোকেনি। বড় সংখ্যক রোহিঙ্গা বাইরে ছড়িয়ে গেছে এমন না।’