কক্সবাজারে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো


শাহীন মাহমুদ রাসেল :

শহরের অভিজাত এলাকার হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে ভ্যাট ফাঁকি বেড়েই চলেছে। ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নিয়েও জমা দিচ্ছে না সরকারি কোষাগারে। কেউ কিছু দিচ্ছে, অনেকে একেবারে দিচ্ছে না। অথচ ভোক্তার কাছ থেকে ঠিকই কড়ায়গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ভ্যাট আদায় করার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা রয়েছে। আছে নানান অভিযোগও। তবে অভিযোগ যাই থাকুক না কেন, লোকসান হচ্ছে সরকারের। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সম্প্রতি বিভিন্ন অভিজাত রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে বড় ধরনের ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়বে বলে মনে করেছেন বিশিষ্টজনেরা। দেখা যাবে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ কোটি টাকার উপরে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এমনটাই মনে করেন তারা। এছাড়া শুধু আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের হান্ডি, করাই, কয়লা,শর্মা কিংস, কুটুমবাড়ি, কেএফসি,লাইফ ফিস, সীল্যাম্প, সল্টসহ এগুলোর বেশির ভাগেরই ভোক্তার কাছ থেকে ঠিকই কড়ায়গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করলেও সরকারী কোষাগারে দিচ্ছেনা বলে জানা গেছে। আবার অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই। রীতিমতো আবাসিক এলাকার মধ্যে এভাবে রমরমা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চলছে নির্বিঘ্নে। অপরদিকে কক্সবাজারের বড় বড় আবাসিক হোটেল এবং শপিংমলের আশপাশে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে তো ভ্যাট দেয়ার কোনো বালাই নেই। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই পকেটস্থ করছে।

জানা গেছে, একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ এবং ক্রেতার অজ্ঞতাকে পুঁজি করে দিনের পর দিন ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো। ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করলেও সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ভ্যাট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় হোটেল মালিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। বলা হয়, তাদের লাভের বড় অংক আসে ভ্যাট থেকে। এসব হোটেলের বেশির ভাগই কলাতলী এবং বীচ রোডের মতো আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।

যেগুলোর ব্যবসা করার অনুমোদন নেই। ভ্যাট আইনে হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর ক্ষেত্রে ইসিআর (ইলেকট্রিক ক্যাশ রেজিস্টার) মেশিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। ক্রেতাদের ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) চালান দেয়া হলেও মেশিন ফিসক্যাল করা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে সাদা কাগজে, নিজস্ব প্যাডে খাবারের দামের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়, যা আইনসিদ্ধ নয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের আস্থায় নিতে কম্পিউটারের বিলের কপিতে ভুয়া বিআইএন ব্যবহার করছেন।

এক্ষেত্রে ভ্যাটের পুরো অর্থ নিজের পকেটে ঢুকানো হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে দাখিলপত্রে শীতাতপহীন হিসেবে নিবন্ধিত। এর ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এসব কারসাজির ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই খাত থেকে কাংক্ষিত অংকের ভ্যাট আদায় করতে পারছে না সরকার।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি সরকার ১১টি ব্যবসা ও সেবার ক্ষেত্রে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। এগুলো হচ্ছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, আসবাবপত্র বিপণন কেন্দ্র, বিউটি পার্লার, কমিউনিটি সেন্টার, শপিং সেন্টারের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জেনারেল স্টোর, বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং স্বর্ণ ও রুপার দোকান। কিন্তু এতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও সরকার রাজস্ব আয় থেকে পেছনে পড়ে গেছে।

সম্প্রতি ফেসবুক পেজে মেহেদী হাসান নামের এক ব্যক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু অভিযোগ উত্থাপন করেন। সেখানে হান্ডি রেস্টুরেন্টের বিলের কপি পোস্ট করে তিনি লেখেন, ভ্যাট গোয়েন্দাদের হান্ডি রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানো প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিদিন একই কায়দায় ইসিআর ছাড়া খাবারের বিলের সঙ্গে ভ্যাট আদায় করে।

মিজান নামের একজন বলেন, কেএফসি রেস্টুরেন্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও দাখিলপত্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, দু’ভাবেই ভ্যাট পরিশোধ করেছে, যা ভ্যাট আইনে আইনসিদ্ধ নয়। এছাড়া কাঁচা চালান ইস্যু, ইসিআর থাকা সত্ত্বেও সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে ইসিআর চালান দেয় না, বড় ধরনের পার্সেলের ক্ষেত্রে সাদা নিজস্ব চালান ব্যবহার করে, নিজস্ব প্যাডে ও সাদা কাগজে হাতে লেখা বিল প্রদান করে এবং মূল্য তালিকায় ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভূত উল্লেখ না করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে।

ভ্যাট গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে কাংক্ষিত অভিযান পরিচালনা এবং মনিটরিং করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি জনবল চেয়ে এবং ঢাকার বাইরে আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার হলেও নিয়মিত দাখিলপত্র পেশকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার। তাই রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও নিরীক্ষার মাধ্যমে অনিয়ম থামাতে আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভ্যাট গোয়েন্দার অতিরিক্ত মহাপরিচালক বেলাল হোসেন চৌধুরী বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সম্ভাবনার ৫০ শতাংশ ভ্যাটের আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। মালয়েশিয়া ৩ বছর আগে ভ্যাট ব্যবস্থা চালুর পর দেশটির রাজস্ব আদায়ের চিত্র বদলে গেছে। ভবিষ্যতে ভ্যাট হবে অডিটনির্ভর। তাই সঠিকভাবে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাট গোয়েন্দার জনবল কম। তাই সারা দেশে আঞ্চলিক কার্যালয় খোলার জন্য ১৩৬০ জনের জনবলের প্রস্তাব এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন কমিশনার এবং ১ জন চিফ কমিশনার থাকবে। এছাড়া বর্তমান জায়গায় অফিস পরিবর্তন করে বাংলামোটরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ভ্যাট গোয়েন্দাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করছে না সেখানে কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেয়া হবে। তারা বিক্রির রেকর্ড সংগ্রহ করবে। ভ্যাট গোয়েন্দার ফেসবুক পেজে সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানান তিনি।