ইয়াবার জাদুতে ধনী!

কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক :

ছবি -সংগৃহীত

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে লেডা স্টেশনের কাছে রাস্তার পাশেই চোখে পড়বে একটি দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এই বাড়িটির মালিক নূরুল হুদা। ৩৬ বছর বয়সী এই ব্যক্তি হ্নিলা ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য। কিন্তু, এটিই তার একমাত্র পরিচয় নয়।

তালিকাভুক্ত এই মাদকব্যবসায়ী ১০টি মামলার পলাতক আসামি। তবে সৌভাগ্যক্রমে তিনি এখন রয়েছেন সরকারের ‘নিরাপদ নিবাসে’। অন্তত ৬২ জন সন্দেহভাজন ‘ইয়াবা সম্রাটের’ মতো তিনিও গত সপ্তাহে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

আশা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহগুলোতে আরও তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করবেন।

পুলিশের সূত্রে জানা যায়, নূরুল হুদা’র ছোটভাই নূরুল কবিরও বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি। তিনিও এখন রয়েছেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ লাইন্স প্রাঙ্গণে স্থাপিত ‘নিরাপদ নিবাসে’।

মাত্র ১০ বছর আগে নূরুল হুদা ছিলেন একটি ভাড়া করা গাড়ির চালক। তার পাঁচ ভাই কখনো মাছ ধরে আবার কখনো স্থানীয় লবণ ক্ষেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

তবে, ধন্যবাদ মরণনেশা ইয়াবাকে! এর বদৌলতে বদলে গেছে তাদের জীবন। এখন এই পরিবারের রয়েছে ডজনখানেক ‘বিলাসবহুল’ বাড়ি, একরের পর একর জমি ইত্যাদি। এসব তথ্য জানা যায় পুলিশ এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে।

এলাকা পরিদর্শন করে আরও চারজন মাদকব্যবসায়ীর প্রথমদিককার জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। তারা আরও জানতে পারেন কীভাবে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি’র সংস্পর্শে এসে তাদের জীবন বদলে যায়।

তারা হলেন বদি’র ভাই- ফয়সাল রহমান, সৎভাই আব্দুল আমিন, ভাগ্নে শাহেদুর রহমান নিপু এবং টেকনাফ পৌরসভার নূরুল বাশার নওশাদ। তারা সবাই এখন সেই ‘নিরাপদ নিবাসের’ অধিবাসী।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে রয়েছে- বদি হলেন বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসার একজন শীর্ষ পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু, তিনি তা অস্বীকার করে উল্টো দাবি করেন যে কায়েমিস্বার্থবাদী একদল ব্যক্তি তার সুনাম নষ্ট করার করার চেষ্টা করছেন। এসব ব্যক্তিদের অনেকে তার দল বা সরকারে রয়েছেন।

বদলে যাওয়া জীবন

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনরা জানান, নূরুল হুদা’র জীবন বদলে যেতে শুরু করে ২০০৮ সালে। সে বছরে তার বড়ভাই নূর মোহাম্মদ নামেন ইয়াবা ব্যবসায়।

এরপর নূর তার তিন ভাই- শামসুল হুদা, নূরুল আফসার এবং নূরুল কবিরকে নামান এই ব্যবসায়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের সম্পদ।

কয়েক বছরের মধ্যে নূর নিজেই তৈরি করেন তিনটি ‘বিলাসবহুল’ বাড়ি। সেগুলো রয়েছে টেকনাফের দামদামিয়া, নাইট্যংপাড়া এবং গুদারবিলে। ২০১৪ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নূর মারা যাওয়ার পর থেকে সেই বাড়িগুলোতে এখন আর কেউ থাকেন না।

মাস পাঁচেক আগে লেডায় রোহিঙ্গা শিবিরের কাছে তাদের আরেক ভাই শামসুল হুদা নিহত হন অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে। আর নূরুল আফসার একটি মাদক মামলায় পাঁচ বছরের কারাভোগ করছেন।

গত বছর মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর নূরুল হুদা এবং তার ছোটভাই নূরুল কবির আত্মগোপন করেন। আত্মসমর্পণ কর্মসূচির খবর পেয়ে তারা চলে আসেন প্রকাশ্যে।

এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্যে তাদের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।

টেকনাফের ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরুল বাশার নওশাদের উত্থানের পেছনেও রয়েছে বেশ জাদুকরী গল্প।

এক সময় তিনি একটি চায়ের দোকান চালাতেন। এখন তিনি টেকনাফের কুলাল পাড়ায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক।

স্থানীয়দের অভিমত, শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল করিমের ভাগ্নিকে বিয়ে করার পর তিনি অনেক ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠে।

সূত্র জানায়, বিয়ের কয়েকদিন পর নওশাদ এই মাদকব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। শুরু করেন নতুন জীবন।

২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে নওশাদ তার চাচা মোহাম্মদ আমিন বুলু’কে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে- নওশাদ ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে ভোট কিনেছিলেন।

নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি মিয়ানমারের অধিবাসী এক নারীকে বিয়ে করেন। খবরে প্রকাশ, সেই নারী একজন শীর্ষ ইয়াবা প্রস্তুত ও সরবরাহকারী।

নওশাদের ছোটভাই মিজান-ও ইয়াবা ব্যবসায় নিয়োজিত বলে জানায় পুলিশের বিভিন্ন সূত্র।

তবে বাবা মোহাম্মদ ইউনুসের দাবি- তার ছেলেরা নির্দোষ। স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তালিকায় তাদের নাম দিয়েছেন।

পুলিশ ও র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ইঙ্গিত দিয়ে ইউনুস বলেন, “এখন আমি তাদেরকে ‘নিরাপদ নিবাসে’ পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে তারা বাঁচতে পারে।”

গত বছরের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮৫ ‘মাদক ব্যবসায়ী’ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

স্থানীয়দের বক্তব্য, বদি’র ভাগ্নে ৩১ বছর বয়সী নিপু আগে চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। কিন্তু, ২০০৮ সালে বদি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি প্রচারণার কাজে যোগ দিতে কক্সবাজার আসেন।

নিপু’র বাবা আব্দুর রহমান পুলিশের একজন পরিদর্শক হিসেবে অবসরে যান।

নির্বাচনের পর বদি’র প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নিপু ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএনএফ) ব্যবসা শুরু করেন। এরপর জড়িত হন ইয়াবা ব্যবসায়।

এক সময় শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে উঠা এই ব্যক্তির নিজের ‘বিলাসবহুল’ বাড়ি রয়েছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে।

নিপু’কে কখনো আটক করা হয়নি। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর তিনি মালয়েশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন বলে জানান অনেকে। গত সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি দেশে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

নিপু’র চাচাতো ভাই আক্তার কামালও একজন তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ী। গত বছর অক্টোবরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কামাল নিহত হন। নিপু’র আরেক চাচাতো ভাই ও তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ী শহীদ কামাল এখন তার সঙ্গে সেই ‘নিরাপদ নিবাসে’ রয়েছেন।

সূত্র মতে, বদি’র সৎভাই আব্দুল আমিন ২০০৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় থাকতেন। বদি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে তিনি কক্সবাজারে ফিরে এসে টেকনাফ বন্দরে সিএনএফ-এর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নেন। দেশের বিভিন্ন অংশে মাদক সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

স্থানীয়রা জানান, যদিও আমিনের বেশ কয়েকটি গাড়ি রয়েছে তথাপি তিনি নিজে সিএনজি-চালিত অটোরিকশা ব্যবহার করেন। তার নিজের অন্তত ডজনখানেক অটোরিকশা রয়েছে যেগুলো ইয়াবা সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা হয়।

বদি’র ভাই ফয়সাল রহমানেরও একই সংখ্যক অটোরিকশা রয়েছে। সেগুলোও এই কাজে ব্যবহার করা হয় বলে জানায় বিভিন্ন সূত্র।

ফয়সালের মা একজন রোহিঙ্গা। ফয়সাল তার সৎভাইদের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত হন বলে মন্তব্য স্থানীয়দের।

নিজের পরিবারের সদস্যদের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বদি বলেন, তিনি তার পরিবারের সদস্যসহ সব মাদকব্যবসায়ীকে অনুরোধ করেছেন ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করার জন্যে।