ডা. আকাশের আত্মহত্যা নিয়ে আলেমরা যা বললেন….

ডেস্ক রিপোর্ট – স্ত্রীকে দায়ী করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যার ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। স্ত্রীর পরকীয়ার জেরে এ চিকিৎসকের আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে।

বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, ডা. আকাশের বিয়ের দিনমোহর নির্ধারিত হয়েছিল ৩৫ লাখ টাকা। তালাক দিলে যা পরিশোধ করতে হত। মোটা অংকের এ টাকার জন্য তিনি স্ত্রী মিতুকে হয়তো তালাক দেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কথাও উঠে এসেছে ।

এমন অবস্থায় আকাশের আত্মহত্যা কি ঠিক নাকি অন্য কোন উপায়ে সমাধান করা যেত!

এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ও তেজঁগাও মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার রিসার্চ ফেলো ও শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী।

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী।

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী বলেন, বর্তমানে যত সামাজিক সমস্যা হচ্ছে, এর মূল কারণ দেখলে স্পষ্ট হয় যে, শরিয়তের নির্দেশনা অমান্য করার কারণেই নানাধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ডা. আকাশ দম্পতির এ মর্মান্তিক ঘটনা এখন আমাদের সামনে রয়েছে। তাদের দাম্পত্য জীবন যখন অসহনীয় হয়ে গেল, তালাকই ছিল সুন্দর সমাধান। কিন্তু মোটা অংকের মোহর এখানে বড় একটি বাধা সৃষ্টি করেছে।’

‘মোহরের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি যে শরীয়তের নির্দেশনা মানা হয়নি। ইসলামে মোহরের ক্ষেত্রে যে সুন্দর নির্দেশনা রয়েছে, অনেক বড় অঙ্কের মোহর ধার্য করা যেমন শরীয়তে কাম্য নয়, তেমনই তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কিরামের সাধারণ রীতি এ ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ’ যোগ করেন এ আলেম।

ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ বলেন, স্ত্রীর অপকর্মগুলো জানার পর ডা. আকাশ স্ত্রীকে শরীয়াহ মোতাবেক তালাক দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি আত্মহত্যা করলেন, যা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুতর অপরাধ। আত্মহত্যার মাধ্যমে তার নিজের ক্ষতি হয়েছে শুধু তা নয়, তার পরিবারও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রাষ্ট্রও একজন চিকিৎসক হারিয়েছে। এ জন্য দাম্পত্য কলহ অসহনীয় হয়ে গেলে তখন তালাকের সুযোগ ইসলামে রয়েছে। আত্মহত্যা বা নির্যাতন কোনো সমাধান নয়।

ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ

বিবাহের মোহর ও তালাক প্রসঙ্গে ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘বিবাহ যেহেতু মানবজীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ, তাই ইসলামে বিবাহের বিষয়টি খুবই সহজ করা হয়েছে। বিবাহের খরচসহ যাবতীয় বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা মেনে চললে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এতোটা প্রকট হতো না। ’

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ভোরে নগরীর চান্দগাঁও থানা এলাকায় নিজবাসায় নিজের শিরায় বিষ প্রয়োগ করে আত্মহত্যা করেন আকাশ। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর নন্দনকানন এলাকা থেকে স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতুকে তার খালাতো ভাইয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এরপর মিতুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আমানত শাহ (র.) মাজার এলাকা থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে আকাশের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি জব্দ করে পুলিশ।

আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দিয়ে মৃত্যুর জন্য স্ত্রী মিতুকে দায়ী করেন এবং বিস্তারিত ঘটনার আবেগঘন বর্ণনা দেন আকাশ।

ফেসবুকে শেষ পোস্ট দেন ভোর ৪টা ৫২ মিনিটে। তাতে স্ত্রীর সঙ্গে তোলা একটি সেলফি পোস্ট দিয়ে আকাশ লিখেন, ভালো থেকো আমার ভালোবাসা তোমার প্রেমিকদের নিয়ে।

এর প্রায় আধ ঘণ্টা আগে (৪টা ২৬ মিনিটে) কয়েকটি ছবি, সামাজিকমাধ্যমের মেসেজের স্ক্রিনশট ও একটি ভিডিও পোস্ট করেন আকাশ। সেখানে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তারিত বর্ণনা করেন তিনি। আকাশ লিখেন, ‘আমার সাথে তানজিলা হক চৌধুরী মিতুর ২০০৯ সাল থেকে পরিচয়। প্রচণ্ড ভালবাসি ওকে। ও নিজেও আমাকে অনেক ভালবাসে। আমরা ঘুরে বেড়াই, প্রেম করে বেড়াই। আমাদের ভালোবাসা কম বেশি সবাই জানে। অনেকে বউ পাগলাও ডাকত। ২০১৬ সালে আমাদের বিয়ে হয়, বিয়ের কয়েকদিন আগে জানতে পারি কিছুদিন আগে শোভন নামে চুয়েটের ০৮ ব্যাচের এক ছেলের সাথে ও হোটেলে রাত কাটায়, আর কত কি লজ্জা লাগছে সব লিখতে। ততদিনে সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দেওয়া শেষ, আমাকে যেহেতু চট্টগ্রামের সবাই চিনে তাই বিয়ে ক্যানসেল করতে পারিনি লজ্জাতে।’

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজনের সঙ্গে মিতুর ‘শারীরিক সম্পর্কে’র কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভাইবারে থাকা স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে জানতে পারেন বলে দাবি করেন আকাশ। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলে মিতু কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়েছে বলেও ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান আকাশ।

তিনি জানান, এই ঘটনার পর এক বছর ভালোভাবেই সংসার করেন তারা। পরে মিতু যুক্তরাষ্ট্রে যান, এই ফেব্রুয়ারিতে আকাশেরও যাওয়ার কথা। জানুয়ারিতে আকাশ জানতে পারেন, বিদেশে গিয়েও মিতুর অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা। আকাশ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘…আমি বারবার বলছি, আমাকে ভালো না লাগলে ছেড়ে দাও কিন্তু চিট করো না, মিথ্যা বলো না। আমার ভালবাসা সবসময় ওর জন্য ১০০% ছিল। আমি আর সহ্য করতে পারিনি। আমাদের দেশে তো ভালবাসায় চিটিং-এর শাস্তি নেই। তাই আমিই বিচার করলাম, আর আমি চির শান্তির পথ বেঁচে নিলাম।’

‘তোমাদেরও বলছি কাউকে আর ভালো না লাগলে সুন্দরভাবে আলাদা হয়ে যাও, চিট করো না, মিথ্যা বলো না। আমি জানি অনেকে বিশ্বাস করবে না, এত অমায়িক মেয়ে আমিও এসব দেখে ভালোবেসেছিলাম। ভিতর-বাহির যদি এক হতো। সবাই আমার দোষ দিবে সবকিছুর জন্য তাই ব্যাখ্যা করলাম। আমার শাশুড়ি দায়ী এসবের জন্য, মেয়েকে আধুনিক বানাচ্ছে। একটু বেশি বানিয়ে ফেলেছে। উনি চাইলে সমাধান হতো। আমি শেষ পর্যন্ত চাইছি সব চুপ রেখে সমাধান করে মিতুকে নিয়ে থাকতে। আমার শ্বশুর আর শাশুড়িকে বারবার বলছি, উনারা সমাধান করতে পারত! আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার বউ, যাকে ৯টা বছর যাকে ১০০% ভালোবাসছি। আমি বোকা ছিলাম তুমি সুখে থেকো। মরার আগে কেউ মিথ্যা বলে না, আর বাইরে থেকে মানুষের ভিতরের চেহারা বুঝা যায় না। ও সুন্দরী, পড়ায় ভালো, গান পারে সত্য কিন্তু সে ভালো অভিনেত্রী, ভালো চিটার। যাদের ইচ্ছা বিলিভ করবে, আর যাদের ঈচ্ছা নাই করবে না। তবে কাউকে ভালোবেসে চিটারগিরি করো না।’

জানা যায়, সাত বছরের প্রেমের সূত্র ধরে তিন বছর আগে ২০১৬ সালে পারিবারিকভাবে মিতুর সঙ্গে আকাশের বিয়ে হয়। বিয়ের পর মিতু বেশি সময় কাটিয়েছেন মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায়। মাঝেমধ্যে মিতু স্বামীর কাছে আসতেন। দেশে আসার পরও মিতু স্বামীর বাসায় নয়, বেশির ভাগ সময় থাকতেন তার বাবার চান্দগাঁও এলাকার বাসায়। মিতুও পেশায় একজন ডাক্তার। ২০১৪ সালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

আরও খবর