বদি পরিবারের ১০ সদস্যসহ শতাধিক ইয়াবা কারবারী সেফহোমে

ইমাম খাইর :

জলদস্যুদের পর এবার আত্নসমর্পণ করতে যাচ্ছে মরণনেশা ইয়াবা কারবারীরা। যাদের মধ্যে শীর্ষ ২৯ জনসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৫৭ জন রয়েছে। ইয়াবার পাশাপাশি তারা জমা দিতে পারে ইয়াবা তৈরীর সরঞ্জাম, টাকা এবং অস্ত্র। একটি বেসরকারী টেলিভিশনের সহযোগিতায় পুলিশের কয়েক মাসের টানা চেষ্টায় আত্নসমর্পণ প্রক্রিয়া সফলতার পথে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশের সেফহোমে নেয়া হয়েছে শতাধিক ইয়াবা কারবারী।

আত্নসমর্পণকারীদের মধ্যে বহুল আলোচিত সরকার দলীয় সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ১০ জন নিকটাত্নীয়সহ শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারী রয়েছে। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠান ঠিক করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপির হাতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আত্নসমর্পণ করবে।

আত্নসমর্পণের জন্য ইতোমধ্যে সেফহোমে রয়েছেন- সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদু শুক্কুর, আবদুল আমিন, মো. শফিক, মো. ফয়সাল, বেয়াই শাহেদ কামাল, চাচাতো ভাই মো. আলম, ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম, ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু, খালাতো ভাই মং মং সিং, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়া, ভাইপো মো. সিরাজ, হ্নীলার ইউপি সদস্য জামাল হোসেন, নুরুল হুদা মেম্বার, তার ভাই নুরুল কবির, টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ, নারী কাউন্সিলর কহিনুর বেগমের স্বামী শাহ আলম, টেকনাফ সদর ইউপি সদস্য এনামুল হক, ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, ছৈয়দ আহমদ ছৈতু, শফিকুল ইসলাম, মো. ইউনুছ, একরাম হোসেন, রেজাউল করিম মেম্বার, মোজাম্মেল হক, জোবাইর হোসেন, মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু, মো. ইউনুছ, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহর দুই ভাই জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমানসহ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ২ থেকে ১৬টি মামলা রয়েছে। ইয়াবা ডন খ্যাত হাজি সাইফুল করিমও আত্নসমর্পণে আসছেন বলে একটি সুত্রে জানা গেছে। এমপি বদির আরেক ভাই পৌর কাউন্সিলর মাওলানা মুজিবুর রহমানও আত্নসমর্পণ করতে পারেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৩ জনের মধ্যে অন্যতম। তবে, আত্নসমর্পণকারীরা ‘সাধারণ ক্ষমা’ পাওয়া আশা করছে।

এদিকে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক এমএম আকরাম হোসাইন। ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন বেশ কয়েকটা। শুধু প্রতিবেদনে থেমে থাকেননি। প্রশাসন ও ইয়াবা কারবারীদের সাথে সমন্বয় করেন। কথা বলেন তাদের পরিবারের সাথে।

এমএম আকরাম হোসাইন জানান, তার মাধ্যমে আত্নসমর্পণ করা জলদস্যুদের সঙ্গে কারাগারে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে বাইরে থাকা আত্নীয়স্বজনদের দেন ওই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তারা আকরাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এরইমধ্যে শীর্ষ অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী স্বেচ্ছায় পুলিশের হেফাজতে চলে এসেছেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইয়াবার সম্রাজ্যের পতন হবে বলে মনে করেন সাংবাদিক আকরাম হোসাইন। গত ২১ অক্টোবর মহেশখালীর অস্ত্রের কারখানা ও জলদস্যুদের আত্নসমর্পণ করিয়ে পুরো দেশে আলোচিত হন চৌকষ সাংবাদিক এমএম আকরাম হোসাইন।
একটি সুত্রে জানা গেছে, আত্নসমর্পণের জন্য ১২০ জনের মতো মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের হেফাজতে গিয়েছেন। ১৬ ফেব্রুয়ারির আগে এই সংখ্যা প্রায় ২০০ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে পুলিশ হেফাজতে থাকা মাদক ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও ২০২ জন ইয়াবা কারবারির তালিকা চূড়ান্ত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁদের মধ্য থেকে কয়েকজন আত্নসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি (গডফাদার)। তাঁদের ৬৬ জনই টেকনাফের বাসিন্দা।

গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজার জেলায় ৪৪ মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফে মারা গেছে ৪০ জন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব ক’টি তালিকায় ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে আবদুর রহমান বদি ও ইয়াবা গডফাদার হিসেবে তাঁর পাঁচ ভাই, এক বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্নীয়ের নাম রয়েছে।

পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপি ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বিমানযোগে কক্সবাজার পৌঁছবেন। একইদিন তিনি জেলা পুলিশ ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ইয়াবাবাজদের আত্নসমর্পণের সার্বিক প্রস্তুতি ও অনুষ্ঠানে ইয়াবাবাজদের কি কি করা হবে- এবিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে বৈঠক করবেন।

পরদিন শনিবার সকাল ১০ টায় টেকনাফে ইয়াবাবাজদের আত্নসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপি। অনুষ্ঠান সার্বিক তদারকী করার জন্য আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী (বিপিএম), ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিমানযোগে কক্সবাজার পৌঁছাবেন। শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, বৃহস্পতিবার পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক (বিপিএম-বার, পিপিএম)ও কক্সবাজার আসবেন। অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) সভাপতিত্ব করবেন। ইয়াবাবাজদের আÍসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখভাল করার জন্য চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন এন্ড ক্রাইম) মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী (বিপিএম) শনিবার বিকেলে বিমানযোগে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপি রোববার সকালে বিমানযোগে কক্সবাজার ত্যাগ করবেন বলে জেলা পুলিশ সুত্রে জানা গেছে। আত্নসমর্পণকারী ইয়াবাবাজদের অনুষ্ঠানে কি করা হবে? জানতে চাইলে এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

আত্নসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেলার সংসদ সদস্যবৃন্দ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ভিভি আইপি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।অন্য একটি সুত্র জানিয়েছে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সরকারি তালিকার এক নম্বর ক্রমিকে থাকা ইয়াবা নিয়ে বহুল আলোচিত উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর বদিকে আত্নসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবেনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সর্বশেষ তৈরীকৃত আপডেট তালিকা অনুযায়ী ১১৫১ জন ইয়াবাবাজ রয়েছে। সেখানে মাত্র প্রায় দেড়’শ ইয়াবাবাজ আত্নসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর বাকী তালিকাভুক্ত ও অন্যান্য ইয়াবাবাজদের কি হবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) বলেন-তাদের বিষয়ে সরকার মামলা ও অন্যান্য আইনানুগ কঠিন ব্যবস্থা নেবে। আত্নসমর্পণকারীরা যদি সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার আওতায় আসে, ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলা অস্বাভাবিক সম্পদের বিষয়ে কি হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) বলেন-আত্নসমর্পণ করা ইয়াবাবাজদের বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক সম্পদের বিষয় গুলো এনবিআর, দুদকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ দেখবেন এবং সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।

আত্নসমর্পণকারীদের আইনী বিষয় কি হবে-এ প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন জানান-এতদিন বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের সশস্ত্র জলদস্যু, বিভিন্ন সময়ে ডাকাত বাহিনী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপথগামী শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের আত্নসমর্পণের মাধ্যমে তাদের ম্পাদিত অপরাধের বিষয়ে সরকারের সাধারণ ক্ষমা পেয়েছিল। কিন্তু ইয়াবা কারবারীদের আত্নসমর্পণের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন, ব্যতিক্রম ও সর্বপ্রথম একটা বিষয়। তাই এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজে এসে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। তবে আইনী ও অন্যান্য বিষয়ের জটিলতা নিরসনে ইতিমধ্যে আইনজ্ঞ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সহ আরো বিভিন্ন বিষয় পরিস্কার করেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন-ইয়াবাবাজদের শিকড় উপড়ে ফেলাই আমাদের প্রধান টার্গেট, তাই এই কঠিন টার্গেটে পৌঁছাতে আমাদের অনেক ঝুঁকি নিয়ে শ্রম, মেধা, ত্যাগ ও সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। দেশের সর্বত্র মাদকের সর্বনাশা কুফলের কথা চিন্তা করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ অত্যন্ত সচেতনেতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে এই দুঃসাধ্য ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকে সফলতার মুখ দেখাতে চাচ্ছে। তাই স্পর্শকাতর ও দুঃসাহসী এই কাজ সফল করার জন্য তিনি সিভিল প্রশাসন, জেলার সর্বস্থরের নাগরিক সহ সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

তিনি বলেন, এ অভিযান থেকে আমরা কোন অবস্থাতেই পিছপা হবোনা। যেকোন মূল্যে ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে আমরা ইয়াবাবাজদের মূল উৎপাটন করব।

এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন (বিপিএম) বলেন-আমাদের কঠিন এই অভিযাত্রার সফলতার মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসার গেটওয়ে বলে পরিচিত কক্সবাজারের দুর্নামও ঘুচাতে পারবো। এ অঞ্চলের মাদকের হাঠকে স্বমূলে উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমরা যেকোন হুমকি ও ঝুঁকি দৃঢ় মনোবল নিয়ে মোকাবেলায় প্রস্তুত। তিনি বলেন-পুরো উদ্যোগটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এখানে হোছট খেলে শুধু কক্সবাজার নয়, পুরো দেশ মাদকের ভয়াবহতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। তখন পরবর্তী প্রজম্ম ও বিবেকের কাছে আমরা সবাই অপরাধী হবো।