স্থানীয়দের মাঝে বহাল তবিয়তে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস!

শাহীন মাহমুদ রাসেল :

কক্সবাজার জেলা শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। মিয়ানমারে চলমান নির্যাতনের ঘটনায় গত ১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসব রোহিঙ্গা চলে আসে কক্সবাজার পর্যন্ত। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রশাসন উখিয়ার বালুখালী এলাকায় স্থান নির্ধারণ করলেও কক্সবাজার শহরে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা শহরেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার শহরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান বেশ উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল। তারা বলেন, কক্সবাজার শহর ও আশপাশে এমনিতেই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের কারণে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা চলে আসছে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের। এর ওপর আরো অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা স্থায়ী হলে পর্যটন শহর কক্সবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তারা দ্রুত শহর থেকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে কক্সবাজার প্রশাসনের একাধিক সূত্রের সাথে কথা জানা যায়, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের অবশ্যই চলে যেতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করেছি। খবর পেলেই অভিযান চালাচ্ছি। সম্প্রতি বেশ কয়েক রোহিঙ্গাকে ফেরতও পাঠিয়েছি। শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিতে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের রোহিঙ্গা বিষয়ক মুখপাত্র কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বলেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই কক্সবাজার শহর ছাড়তে হবে। তারা কোনোভাবেই এখানে থাকতে পারবে না। আমরা আগে অন্য কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করছি। এখন রোহিঙ্গারা যাতে শহরে আসতে না পারে সে জন্য চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এর পরও যারা আসছে এবং আগে এসেছে তাদের দ্রুত ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহর ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে অবস্থাসম্পন্ন। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান নিয়েছেন। বেশি টাকার লোভে বাড়ি মালিকরা রোহিঙ্গাদের ভাড়ায় রেখেছেন। এমনকি অনেকেই কক্সবাজার শহরের এলাকাগুলোতে বসতবাড়ি তৈরিতে ক্রয়ের জন্য জমি দেখছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা অর্থনৈতিকভাবে অবস্থাসম্পন্ন রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার শহর ও চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে। তারা এসব এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছে। মিয়ানমার থেকে আনা স্বর্ণ, নগদ টাকা ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে এসব রোহিঙ্গা জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরির চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে ভাড়াবাসায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেরই স্বজন রয়েছে বিদেশে। তারা সেখান থেকেও টাকা পাঠাচ্ছে হুণ্ডিতে।

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার খরুলিয়ায় ভাড়া বাসায় থাকা এক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তার দুই ছেলে মালয়েশিয়া এবং তিন নিকটাত্মীয় রয়েছে সৌদিতে। তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকেও স্বর্ণ ও নগদ টাকা নিয়ে এসেছেন তারা। ওই রোহিঙ্গা আরো জানান, তারা বর্তমানে ভাড়া বাসায় অবস্থান নিলেও শহরের পাহাড়তলিতে থাকা তাদের আত্মীয়দের মাধ্যমে জমি কিনে এখানে স্থায়ী হবেন। এমনকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে নিবন্ধিত হতেও তাদের কোনো আগ্রহ নেই বলে জানায় ওই রোহিঙ্গা। এভাবে সদরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ভাড়া বাসায় প্রায় ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। একইভাবে খরুলিয়ার চেয়ারম্যান পাড়া এলাকায় বেশ কয়েকটি ভাড়া বাসার কলোনিতে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। প্রায় ৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা ঝিলংজা ও মিঠাছড়ি ইউনিয়নের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় রয়েছে।

স্থানীয় এডভোকেট রেজাউর রহমান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের স্রোত যখন তার এলাকার দিকে আসছিল, তখন তিনি অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে তাদের ক্যাম্পে চলে যাওয়ার জন্য বলেন। কিছু কিছু রোহিঙ্গা চলে গেলেও ভাড়া বাসায় অনেকেই রয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া বিসিক এবং কক্সবাজার সরকারি কলেজের পেছনেও অবস্থান নিয়েছে প্রায় তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা।

স্থানীয় ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান জানিয়েছেন, এলাকায় ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের চলে যাওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছেন। এমনকি স্থানীয়রা যাতে রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া অথবা অন্য কোনোভাবে আশ্রয় না দেয় মসজিদগুলোতে তা বলে দিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধান করে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেছে, কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার প্রতিটি পাড়া মহল্লা ছাড়া শহরের সমিতিপাড়া, উত্তর নুনিয়াছড়া, ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, পুলিশ লাইনের পেছনে, চন্দ্রিমা এলাকা, কলাতলী ঝরঝরিকুয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলার পেছনের এলাকা, দক্ষিণ হাজিপাড়া, মেডিকেল কলেজের পেছনে, কক্সবাজার সরকারি কলেজের পেছনে, বিসিক এলাকা, পিএমখালী, ঝিলংজার বিভিন্ন এলাকায় অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে। গত প্রায় দেড় বছরে এসব রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে শহর ও শহরতলির আশপাশের এলাকায়। এর মধ্যে শহরের পাহাড়তলি, সমিতিপাড়া, জেলগেটের আশপাশের এলাকা ও লিংকরোড এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে।