২০০ কোটি টাকার সম্পদ টেকনাফের ৬ মেম্বারের

ডেস্ক রিপোর্ট – আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাগাতার অভিযান আর একের পর এক বন্দুকযুদ্ধ ভয় ধরিয়ে দেয় মাদক কারবারিদের। তাই তো জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে ইয়াবার গডফাদাররা। কোনো উপায় না দেখে আশ্রয় নেয় পুলিশের সেফ হোমে। এরপর ৯ শর্তে ১০২ মাদক কারবারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যাদের মধ্যে টেকনাফের ৬ মেম্বার ও এক কাউন্সিলর অন্যতম।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শর্তগুলোর মধ্যে সম্পদ জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে হিসেবে টেকনাফের মানুষের কাছে এখন বড় কৌত‚হল আত্মসমর্পণকারীদের কার কত সম্পদ? আত্মসমর্পণের পরও কেন সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে না? আত্মসমর্পণকারী ওই ৬ মেম্বারের সম্পদের ওপর অনুসন্ধানে উঠে আসে অঢেল সম্পদের চিত্র ও জিরো থেকে হিরো হওয়ার কাহিনী। তাদের সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে দুইশ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার একজন মেম্বারই একশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তাদের এই অঢেল সম্পদ দ্রুত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেয়ার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। না হলে সম্পদ বিক্রি বা পাচার করে দিতে পারে তাদের পরিবার। পুলিশ বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ধারাবাহিকভাবে ৬ মেম্বারের সম্পদের তালিকা তুলে ধরা হলো :

হেলপার থেকেই কোটিপতি নুরুল হুদা : 
এক সময় গাড়ির হেলপারি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন নুরুল হুদা মেম্বার। স্থানীয়ভাবে পরিচিত নুরা বলে। অপর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ছোট দুজনকে নিয়ে নাফ নদে জাল ফেলতেন তাদের বাবা। তিনজন পরের জমিতে লবণ শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু যাদের জমিতে কামলা দিতেন, কয়েক বছরের মাথায় ইয়াবা ব্যবসার বদৌলতে সেই জমিই কিনে নেন নুরুল হুদা। মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। তারপর একেক ভাইয়ের জন্য বানান একেকটি প্রাসাদ। ওঠাবসা ছিল এমপি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে আর ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে নেতা বনে যান। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হন নুরুল হুদা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হ্নীলার টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পাশেই নুরুল হুদার ছয় ভাইয়ের নামে ছয়টি নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে তাদের বাড়ির সংখ্যা ১৪। টেকনাফের হোছ্যারখালের উত্তর পাশে, হ্নীলা আলীখালী, লেদাবাজার এলাকায় হুদার নিজেরই তিনটি বাড়ি। নিজে বসবাস করেন পুরান লেদায়। ফ্ল্যাট আছে চট্টগ্রামেও। এ ছাড়া হ্নীলা লেদায় শত একর জমি কিনেছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তবে হ্নীলার দমদমিয়া বিজিবি চেকপোস্ট ঘেঁষে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ। যিনি ২০১৪ সালে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে বর্তমানে নুরুল হুদার একাই প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ আছে।

দিনমজুর থেকে কোটিপতি জামাল মেম্বার :
জামাল মেম্বার ছিলেন একজন কৃষিজীবী সাধারণ দিনমজুর। ২০০৯ সালে লবণ ব্যবসার আড়ালে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার আশায় ইয়াবার জগতে প্রবেশ করেন। এরপর ইয়াবা ব্যবসাকে আরো পাকাপোক্ত করতে আরেক শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া নুর মোহাম্মদের মেয়ের সঙ্গে তার ছেলে শাহ আজমের বিয়ে দেন। ছেলেকে বিয়ে দেয়ার পর দুই বেয়াই মিলে গড়ে তোলেন ইয়াবা ব্যবসার সাম্রাজ্য। এরপর রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। একের পর এক গাড়ি-বাড়ি ও জমির মালিক হন। বর্তমানে জামাল মেম্বারের রয়েছে ১০০ একর জমি ও আলিশান বাড়ি। সব মিলিয়ে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি প্রায় ৪০ কোটি টাকা।

ফুটবলার থেকে কোটিপতি এনাম মেম্বার :
নাজিরপাড়ার মোজাহার মিয়ার ছেলে এনাম মেম্বার। ভালো ফুটবল খেলার সুবাদে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এলাকাবাসী জানান, মিয়ানমারভিত্তিক শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত করে এলাকার উঠতি বয়সী যুবকদের অল্প দিনে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার নামে-বেনামে গাড়ি-বাড়ি, ৫টি মুদির দোকান ও চিংড়ির ঘের রয়েছে। কয়েক কোটি টাকার জমি কিনেছেন এনাম। এসব জমি রেজিস্ট্রি না করেই চুক্তিনামার মাধ্যমে ভোগ করছেন তিনি। চট্টগ্রামেও তার কোটি টাকার জায়গা রয়েছে। সব মিলিয়ে তার ১৫ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

সরেজমিন তার বাড়িতে দেখা যায়, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটি ভাঙা বাড়ির পেছনে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ির কাজ শেষ করতে পারেননি। তার আগেই মৃত্যু ভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। তবে ওই বাড়ির পাশেই করেছেন আরেকটি বাড়ি। এনাম মেম্বারের ছোট ভাই হাফেজ নুরুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, এগুলো সবই তাদের পৈতৃক সম্পদ। জমির বিরোধে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।

লবণ ব্যবসায়ী থেকে কোটিপতি রেজু মেম্বার : শাহপরীর দ্বীপের রেজাউল করিম রেজু মেম্বারের বাবা হাজি এবাদুল হক। পরিবার সচ্ছল থাকলেও অর্থের লোভে লেখাপড়া বাদ দিয়ে লবণ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। আশপাশের লোকজন ইয়াবা ব্যবসা শুরু করলে তিনিও এ মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। লবণের ব্যবসায় আড়ালে পুরোদমে চালিয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়। ইয়াবা ব্যবসার আগে তিনি হুন্ডির ব্যবসা করতেন। বর্তমানে সব মিলিয়ে তার প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

মানব পাচার থেকে ইয়াবায় দানু মেম্বার : মোয়াজ্জেম হোসেন দানু মেম্বারের বাবা মাস্টার সৈয়দ আহমদ। বিদেশ থেকে এসে একটি চান্দের গাড়ি কিনেন। এই চান্দের (জিপ) গাড়ির হেলপারি করতেন। কিন্তু হেলপারিতে বেশিদূর এগোতে না পেরে বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এক সময় জড়িয়ে পড়েন মানব পাচারে। প্রশাসন মানব পাচার প্রতিরোধে যখন গুরুতর অভিযানে নামে তখন গাঢাকা দেন তিনি। মানব পাচার করে অর্জিত পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। এ ব্যবসার বদৌলতে হয়ে উঠেন সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তখন থেকে বিরামহীন ইয়াবা ব্যবসা করে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি।

মাছ ব্যবসায়ী থেকে কোটিপতি শামসু মেম্বার : শামসুল আলম ওরফে শামসু মেম্বারের বাবা আলী আহমদ জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। এক সময় মাছ চাষে লিপ্ত হন শামসু মেম্বার। এক পর্যায়ে ইয়াবা ব্যবসায় কোটি টাকার মালিক হন তিনি। নির্বাচিত হন সবরাং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হিসেবে। মাত্র ৫ থেকে ৬ বছরে কয়েকটি বাড়ি ও জমিজমা কেনেন। ১০ কোটি টাকার বেশি তার অর্থ সম্পদ রয়েছে তার।

উল্লেখ্য, আত্মসমর্পণ শর্তে পুলিশ উল্লেখ করে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে নিজে/পরিবারের/আত্মীয়স্বজনের নামে ও বেনামে অর্জিত সব স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি যাচাইয়ের জন্য দুদক/সিআইডি (মানি লন্ডারিং শাখা)/এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সব সংস্থার কাছে তাদের তথ্যাদি পাঠিয়ে সেগুলো যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও আত্মসমর্পণের পরে এখনো সম্পদ জব্দের কার্যক্রম শুরু হয়নি বলে জানিয়েছে টেকনাফ থানা পুলিশ।

/ভোরের কাগজ