বিলুপ্তির পথে কক্সবাজারের সিনেমা হল


শাহীন মাহমুদ রাসেল :

একটা সময় ছিল, যখন সিনেমা হলগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকতো না। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম চলচ্চিত্র হওয়ায় স্বভাবতই এর দর্শক চাহিদাও ছিলো প্রচুর। কিন্তু ওই হলগুলো আজ একেবারে দর্শক শূন্য, দেখলে মনে হয় কোন বিরাণভূমি, অব্যাহত লোকসানে বন্ধ হয়েছে সিনেমা হল। বাকিগুলোরও অবস্থা নাজেহাল। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় এই চিত্র।

কক্সবাজারে সিনেমা হল ছিলো তিনটি। লোকসানের ভার বইতে না পারায় ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি। ২০১০ সালে দিগন্ত সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে এখন ব্যাংক। হলটির মালিক জানান, লোকসানের কারণে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিলো না। তাই বন্ধ করে দিতে হলো। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বন্ধ হয়ে যায় শহরের সিনেমা রোড় এলাকায় অবস্থিত টকি হাউস সিনেমা হল। এর মালিকও একই কথা- লোকসানে টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজারের বাকি একটি সিনেমা হল টিকে থাকলেও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোনো শোতে পাঁচজন, কোনোটাতে ছয়জন, আবার কোনোটাতে দর্শক শূন্য থাকে সিনেমা হল। এভাবে তো আর চলে না- বলছিলেন কক্সবাজার বিডি আর ক্যাম্প এলাকায় অবস্থিত বিডি আর অডিটোরিয়াম সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তিনি জানান, সময়টা বেশিদূরের নয়, যখন দর্শকে মুখর থাকতো সিনেমা হল। প্রতি শোতে দর্শক থাকতো দুইশ’র ওপরে, সারা মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করা যেত, পেট চলতো অর্ধশতাধিক কর্মচারির। কিন্তু এখন সারা মাসে ৮-১০ হাজার টাকাও আয় করা সম্ভব হয় না, কর্মচারি ও যাবতীয় খরচ মেটানোর পর লাভ তো দূরের কথা, উল্টো গুনতে হয় লোকসান। এ ব্যবসায় টিকে থাকাই যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখন আর আগের মতো ব্যবসা নেই, কোনোরকম পেটে-ভাতে বেঁচে থাকা। তিনি অবশ্যই এজন্য দায়ী করেছেন ভারতীয় চ্যানেলের সিনেমা এবং সিরিয়ালকে। তার মতে, মহিলারা এখন সারাদিন ভারতীয় সিনেমায় মজে থাকে, সিনেমা হলে এসে ছবি দেখার সময় কোথায় তাদের? এখনকার ছবিগুলোর দর্শক খেটে খাওয়া মানুষ রিকশা ও ভ্যান চালকদের বিশাল একটা অংশও মোবাইল ফোনে তাদের বিনোদন খুঁজে নেয়।

কিন্তু হলের নিয়মিত দর্শক একজন প্রকাশ করেছেন ভিন্নমত। তিনি মনে করেন, এ শিল্পে ভালো শিল্পীর সংকট চলছে। শাকিব খান-অপু বিশ্বাসকে দিয়ে আর কয়দিন? এ ছাড়া ছবির মানও খুব নিম্নমানের। ছবির মান ও শিল্পীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দর্শকরা সিনেমা হলে আসতে উদ্বুদ্ধ হতো।

গত রবিবার (২১ ফেব্রুয়ারি ) সকালে গিয়ে দেখা যায়, বিডি আর অডিটোরিয়াম সিনেমা হলে ১২-৩টার শোতে চলছে অমিত হাসান ও আলেকজান্ডার বো অভিনীত ‘দুই মাস্তান’। এ শোতে দর্শক পাওয়া গেছে সর্বসাকুল্যে ছয়জন। এর আগের সপ্তায় দুপুর ১২-৩টায় এই হলে চলছিল শাকিব খান-শাহারা অভিনীত ‘রুখে দাঁড়াও’। এ শোতে পাওয়া গেছে সাতজন দর্শক।

সিনেমা হলে দর্শকবিমুখ হওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজারে সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রুনাদ এবং মিজান অভি রহমান জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে প্রেক্ষাগৃহগুলো ছিলো দর্শকে ভরপুর। ওই সময় সাধারণ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা হলে যেতেন ছবি দেখার জন্য। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। হলগুলোর অব্যবস্থাপনা আর ভেতরকার অপকর্মের কারণে সিনেমা হলে যাওয়াকে এখন নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কেউ এটাকে এখন ভালো চোখে দেখে না। এ ছাড়া হলের আসন, পর্দা ও শব্দব্যবস্থাপনার বেহাল দশা তো আছেই।

পংকজ দাস নামের ফুড প্রোডাক্ট কোম্পানির এক এরিয়া ম্যানেজার জানান, আগে একটি টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে টিকিট পাননি। কিন্তু আজ সেই চিত্র নেই, সিনেমা হল এখন দর্শক শূন্য। দর্শক না হওয়ার পেছনে কারণ হলো অব্যবস্থাপনা এবং হলের ভেতরকার নেতিবাচক কর্মকান্ড। এর পেছনে তিনি আবার আকাশ সংস্কৃতিকেও দায়ী করছেন। তার দাবি, দর্শক এখন সিনেমা হলে এসে টাকা খরচ করে সিনেমা দেখতে নারাজ। কারণ এখন প্রায় সবার বাড়িতেই টেলিভিশন রয়েছে। তাতে স্যাটেলাইট সংযোগ থাকায় অনায়াসে দিনভর চলচ্চিত্র দেখতে পারছেন তারা। ভালো সিনেমা নির্মাণ না হওয়াও মানুষকে হলবিমুখ করেছে বলে মন্তব্য তার।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি নজিবুল ইসলাম মনে করেন, রুচিশীল সিনেমা তৈরি হলে অবশ্যই দর্শক সিনেমা হলে আসবে। যেমন- ‘মনপুরা’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘মনের মানুষ’ ছবিগুলো দেখার জন্য মানুষ সিনেমা হলে এসেছে। তিনি মনে করছেন, সিনেমা হলগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে নির্মাতাদের ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে। সরকারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত, যেন দর্শক আবার সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার উৎসাহ পায়।