বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার

ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল’

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি : শিল্পী আনিসুজ্জামান মামুন

ডেস্ক রিপোর্ট- দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল বীর বাঙালি। দেশ স্বাধীন হলেও যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, সেই অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। ফলে স্বাধীনতা এলেও নেতার অনুপস্থিতিতে অপূর্ণতা থেকে গিয়েছিল বিজয়ের গৌরব উদ্যাপনে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন।

১৯৭২ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের অনুলিখন সন্নিবেশিত হয়। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় এই সাক্ষাৎকারটি নেন ডেভিড ফ্রস্ট। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন্ বাংলাদেশ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার করা হয়। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটির পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হল (প্রথম পর্ব)-

ডেভিড ফ্রস্ট: ২৫ মার্চ, রাত আটটা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। গ্রেফতার বরণ করলেন? কেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, সে এক কাহিনী। তা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করবে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।

শেখ মুজিবুর রহমান: আমি ইচ্ছা করলে যে কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব, মৃত্যুবরণ করব। তবু পালিয়ে যাব না। দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ, এই ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরের মতো।

শেখ মুজিবুর রহমান: আমি তা বলিনি, কিন্তু এ কথা সত্য তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম, আমি তাদের জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন। গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় রইল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষকে হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি শক্তিশালী সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, দেশের প্রতিটা ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ, কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনাকে ওরা ঠিক কিভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১.৩০ মিনিট ছিল? তাই নয় কি? তখন কি ঘটল?

শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল। 

ডেভিড ফ্রস্ট: ওরা যখন এলো তখন আপনি বাড়ির কোথায় ছিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর। আমি এই শোবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপরে এদিক, ওদিক- সবদিক থেকে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়। 

ডেভিড ফ্রস্ট: এগুলো সব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান:  হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছয় বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তান বাহিনী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান: সবদিক দিয়ে। ওরা এবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান দুটি নিয়ে বসে থাকতে বলি। এরপর তার কাছ থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসি।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: না, কোন শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা ছিল না। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলাম। আমি দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম,  ‘তোমরা গুলি করছ কেন? কি চাও তোমরা ‘ তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো, বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একজন অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বলল, ‘এই! ওকে মেরে ফেল না।’

ডেভিড ফ্রস্ট: একটা অফিসারই ওদের থামিয়েছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে মারতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। আমি বললাম, ‘তোমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তো যাচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও।’ ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুটি ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, আমাকে কিছু কাপড়-চোপড়সহ একটি ছোট স্যুটকেস দিলেন। তাই নিয়ে আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে ওরা আমায় নিয়ে গেল।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার ৩২নং ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে সেদিন যখন বেরিয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনোদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: না, আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। আমি ভেবেছি, এই-ই শেষ। কিন্তু আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোন কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভাল। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোন হানি না ঘটে।

ডেভিড ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন: ‘যে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পারবা না।’ কথাটি কি এমনই ছিল না?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান এবং একজন মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়। আমি মানুষ। আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আজ আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কোন দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছুকে তাদের জন্য দেবার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। 

ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান:  হ্যাঁ, আমার সব কিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়-চোপড়-সব কিছুই লুণ্ঠিত হয়েছে। মি. ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোন কিছুই আজ নেই।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয় তখন এসব জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?

শেখ মুজিবুর রহমান: পাকিস্তানি ফৌজ আমার সবকিছুই লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য-সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে- কেন ওরা সবকিছু লুণ্ঠন করল?

শেখ মুজিবুর রহমান: এর কি জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা- কেউ রেহাই পেল না। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেয়া, পোড়াবাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব, না-খাওয়া মানুষ- সব বাস করত এই বস্তিতে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেই সব মানুষের উপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হাজারে হাজারে হত্যা করা হয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: কি আশ্চর্য! আপনি বলছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বের করে, খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে।

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, এমনিভাবে গুলি করে তাদের হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: কেন মানুষকে মারল, তারা কোনো পরোয়া করল না?

শেখ মুজিবুর রহমান: না তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি।

ডেভিড ফ্রস্ট: কেবল হত্যার জন্য হত্যা- যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন, মানুষ আসলে ভালো? কিংবা মনে করেন মানুষ আসলেই খারাপ?

শেখ মুজিবুর রহমান: ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে, মনুষ্যত্ব আছে, এমন মানুষও আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের এই ফৌজ- এগুলো মানুষ নয়। এগুলো পশুরও অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র না থাকতে পারে, তা নয়। কিন্তু যে- মানুষ, সে পশুর অধম হয় কিভাবে? কিন্তু এই বাহিনী তো পশুরও অধম। কারণ, একটা পশু আক্রান্ত হলেই মাত্র আক্রমণ করে। তা না হলে নয়। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল অত্যাচার করেছে। ৫দিন, ৭দিন, ১৫দিন নির্মম অত্যাচার করেছে, আর হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন।

শেখ মুজিবুর রহমান:  ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক অফিসার। বাকি কয়েকজন বেসামরিক অফিসার।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনলো ওরা?

শেখ মুজিবুর রহমান: অভিযোগ- রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র, আরো কত কী!

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম অবস্থাটা এমনই যে, যুক্তির কোন দাম নেই; দেখলাম, এ হচ্ছে বিচারের এক প্রসহন মাত্র, তখন আমি কোটে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম: জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিচক্ষণ, জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক কোনো লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট, তাই নয়। তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।

ডেভিড ফ্রস্ট: তার মানে, তার হাতেই ছিল সব?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।

ডেভিড ফ্রস্ট: তার মানে আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান:  তার তো কোন উপায় ছিল না। আমি তো বন্দি।

ডেভিড ফ্রস্ট: হ্যাঁ, তা তো বটেই। আপনার ইচ্ছা- অনিচ্ছার তো কোনো উপায় ছিল না। ওরা কি বিচার শেষ করে, সরকারিভাবে কোনো রায় তৈরি করেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান: ৪ ডিসেম্বর (১৯৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, লেফটেন্যান্ট, কর্নেল, বিগ্রেডিয়ার- এদের সব রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠাল রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।

ডেভিড ফ্রস্ট: আর তাই সেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা ওখানেই আপনাকে কবর দেবে?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে। 

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, আমি জানি এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোন পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।

ডেভিড ফ্রস্ট: ওরা কী আপনাকে বলেছিল ‘এ তো তোমার কবর?’

শেখ মুজিবুর রহমান: না, ওরা তা বলেনি।

ডেভিড ফ্রস্ট: কী বলেছিল ওরা?

শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা বলল ‘না, না, তোমার কবর নয়। ধর যদি বোম্বিং হয়, তাহলে তুমি শেলটার নিতে পারবে।’

ডেভিড ফ্রস্ট: সেই সময়ে আপনার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? আপনি এই সারাটা সময়, ন’ মাস নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন?

শেখ মুজিবুর রহমান: আমি জানতাম, যে কোনো দিন ওরা আমায় শেষ করে দিতে পারে। কারণ, ওরা অসভ্য বর্বর।

ডেভিড ফ্রস্ট: এই অবস্থায় আপনার কেমন করে কাটত?

শেখ মুজিবুর রহমান: এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল, আমার বিশ্বাস, আমার নীতি, আমার পৌনে আট কোটি মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবাসে, ভাই এর মতো, পিতার মতো, আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখলেন, ওরা আপনার কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল?

শেখ মুজিবুর রহমান: আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখ-ভোগ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কি গভীরভাবে ভালোবাসে।

ডেভিড ফ্রস্ট: হ্যাঁ, এ কথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশর আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা, পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।

ডেভিড ফ্রস্ট: কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন?

শেখ মুজিবুর রহমান: আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ই আমাকে রক্ষা করেছেন।

ডেভিড ফ্রস্ট: আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার এক সময় সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এ কি যথার্থ?

শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদীকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তো বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময় সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করল। এ দুদিন আমার ওপর কোনো সামরিক পাহারা ছিল না। দুদিন পরে এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়ত চার-পাঁচ কিংবা ছয়দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।

ডেভিড ফ্রস্ট: এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমান: আমিও জানি না। ওদের ওপর কোনো আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভ কামনা রয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্ট: এমনকি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সময় ইয়াহিয়া বলেছিল, ‘মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেয়া। 

ডেভিড ফ্রস্ট: ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় পরে বলেছিল। ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

ডেভিড ফ্রস্ট: ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, বলেছিল। ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে বলেছিল, না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক বেসামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর নিকট এজন্য আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ।