ডেস্ক রিপোর্ট – সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সমালোচনাও হয়েছে। এসব সমালোচনার মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ফিলিপাইন, দক্ষিণ আমেরিকার উদাহরণ টেনে বলেছেন, অভিযানের সময় মাদক অপরাধীরা অস্ত্র নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালালেই কেবল এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান অভিযান বন্ধ হবে না। যাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন না, তাঁদের পরিণতি ‘তাঁরাই জানেন’।
গতকাল শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিজি প্রেসের মাঠে অনুষ্ঠিত মাদকবিরোধী সমাবেশে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আয়োজিত ওই সমাবেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল হক, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান, অধ্যাপক অরূপরতন চৌধুরী, অধ্যাপক মোহিত কামালসহ স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা বক্তব্য দেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে সমাবেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব বিভাগের কর্মকর্তারা, বিজিবি, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, কারাগারের কর্মকর্তা, সদস্যসহ ১৩টি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। সমাবেশের শেষে মাদকবিরোধী শপথ পাঠ করান ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান।
সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সুশীল সমাজের অনেকেই বলছেন বিনা অপরাধে গুলি করা হচ্ছে, ক্রসফায়ার করা হচ্ছে। আপনারা বিদেশে দেখেন। পাশের ফিলিপাইনে দেখেন, সেখানে কী হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দেখেন। যেখানেই মাদক উৎপাদন হতো, সেখানে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র জমা হতো!’ তিনি বলেন, ‘অনেককে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিনিয়ত খুঁজছে। যার কাছাকাছি যায় সেই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে। তখন কী হবে…আত্মরক্ষার সবারই অধিকার রয়েছে। আপনার-আমার যেমন আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে, তেমনি আমাদের নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীরও রয়েছে। এসব ঘটনা (কথিত ক্রসফায়ার) সেখান থেকেই হয়। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, আমরা কোনো ক্রসফায়ার করি না। তারা (মাদক অপরাধীরা) ফায়ার ওপেন করলেই সেখান থেকে ঘটনা ঘটে। আমরা কোনো কিছুই ছাড় দেব না। নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে কাজ করছে, সেভাবে চলমান থাকবে। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও চলবে।’
ফিলিপাইনে যা হয়েছে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ফিলিপাইনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশটির রদ্রিগো দুতার্তে সরকারের কথিত মাদকবিরোধী যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী এখনো সমালোচিত। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ অভিযানে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৫ হাজার ৫০ জন নিহত হয়েছেন। যাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। যে ঘটনাগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আর বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের ২৮৪ দিনে ৩১২ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৪৮ জন, র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৯৭ জন ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আর ৬৩ জন মাদক ব্যবসায়ীর দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
মাদকবিরোধী অভিযানে ফিলিপাইন ও দক্ষিণ আমেরিকার উদাহরণ টানার বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের নাগরিকেরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার নেতৃত্বে। যখনই বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ আসে, তখন তাঁকে দাঁড় করানো হয় দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, চিলির সালভাদর আলেন্দে বা যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো নেতাদের পাশে; যাঁরা সংগ্রামী, ত্যাগী ও মানুষের স্বত্বহীন অধিকারে বিশ্বাসী। সেই জায়গায় এখন যদি ফিলিপাইনের দুতার্তে বা দক্ষিণ আমেরিকার যেসব নেতার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা রয়েছে, তাঁদের পাশে আমাদের দাঁড় করানো হয়, সেটা হবে দুঃখের বিষয়। মন্ত্রী মহোদয় যখন তাঁদের কথাই টেনে আনলেন, সে জন্য আমাদের আরও বেশি শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।’
আত্মসমর্পণ নিয়ে
টেকনাফে ১০১ জন মাদক ব্যবসায়ী কৃতকর্মের জন্য অপরাধ স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে যাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন না, তাঁদের পরিণতির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দলে দলে এখন সারেন্ডার করার অভিপ্রায় প্রকাশ করছে। যাঁরাই সারেন্ডার করবেন, তাঁদের আমরা অবশ্যই শেষ সুযোগ দেব। নতুবা আপনাদের জেলে যেতেই হবে। আর আপনারা যদি অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনাদের কী পরিণতি হবে, সেটা আপনারাই জানেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কারাগারে ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজারের মতো। সেখানে ৯৩ হাজার বন্দী আছেন। এর অধিকাংশই মাদক অপরাধে যুক্ত। দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে কেউ কেউ বলছেন। এটা একটা ভয়ংকর সংখ্যা।’
সারা দেশে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, যার মধ্যে ৮২ শতাংশ তরুণ বলে সমাবেশে জানিয়েছেন অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেন, রাজনীতিবিদদের মাদক দমন বিষয়ে বেশি বেশি করে ভাবতে হবে। সন্তানদের নিয়মিত খোঁজ রাখার ওপর গুরুত্ব দেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব শহিদুজ্জামান। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, তাঁদের কাছে প্রতিদিনই অসংখ্য বাবা-মা এসে বলেন যে সন্তানের কারণে তাঁদের জীবনের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
সভাপতির বক্তব্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, নিধিরাম সর্দারের অপবাদ কাটিয়ে এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খোলনলচে বদলে ফেলার কাজ চলছে।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মোসাদ্দেক মো. আবুল কালাম, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর শফিউল্লাহ, মুন্সী কামরুজ্জামান কাজল প্রমুখ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-