রোহিঙ্গা শিবিরে সশস্ত্র গ্রুপ মিয়ানমারের ইন্ধনে!

তোফায়েল আহমদ, কালেরকন্ঠ :

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি ক্রমেই হানাহানির দিকে মোড় নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠছে শিবিরের অভ্যন্তরে।

খোদ রোহিঙ্গা নিধনকারী বলে পরিচিত প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সরকারও গোপনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছে বলে উদ্বেগজনক খবর এসেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কাছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে শুধু রাতে নয়, দিনের বেলায়ও চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। শিবিরগুলোতে পরস্পরবিরোধী দুটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এমনকি উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে তিনটি রোহিঙ্গা শিবির এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের নিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শিবিরগুলোর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনাখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাটসহ নানা জঘন্য অপরাধজনক ঘটনা লেগেই রয়েছে।

সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও উখিয়ার কুতুপালং ই-২ শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঠেকিয়ে দিয়েছেন সেনা সদস্যরা। শিবিরের কয়েকটি মসজিদের মাইকের ঘোষণায় দ্রুত ঘটনাস্থলে সেনা সদস্যরা ছুটে যাওয়ায় বড় ধরনের হামলার ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক রাশেদুল ইসলাম গতকাল শনিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আকস্মিক বিপুলসংখ্যক হামলাকারী কর্তৃক শিবিরে হানা দেওয়ার খবর পেয়েছিলাম।

ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য রওনা দিতেই জেনেছি, সেখানে আমাদের আগেই সেনা সদস্যরা পৌঁছে পরিস্থিতি নিযন্ত্রণে এনেছেন। ’

শিবিরের রোহিঙ্গা শেড মাঝিরা (রোহিঙ্গা দলনেতা) জানান, বর্তমানে শিবিরগুলোতে আল ইয়াকিন নামের একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ বেশ সক্রিয় রয়েছে। আল ইয়াকিন নামের সংগঠনটির বেশির ভাগ রোহিঙ্গা আগে আরএসও নামক সংগঠনে ছিল। আল ইয়াকিন সংগঠনকে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আরসা হিসেবেও বলে থাকে। সংগঠনটিতে রয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবক। সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে আল ইয়াকিন বা আরসা নামের সশস্ত্র সংগঠনটি একটি বড় ধরনের আতঙ্কের নাম।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কাছে আরেক ত্রাস হিসেবে পরিচিত হচ্ছে ‘ডাকাত বাহিনী’। ডাকাত বাহিনীটি আবার এক নামে ‘নবী হোসেন বাহিনী’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি শিবিরেই রয়েছে রোহিঙ্গা ডাকাত নবী হোসেন বাহিনীর তৎপরতা। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নবী হোসেন, ইউনুস, মৌলভী আইউবসহ আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার নেতৃত্বে থাকা বাহিনীটির প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র। এই বাহিনীর সদস্যরা রাতে এমনকি দিনেও ডাকাতি, ছিনতাইসহ খুনখারাবিতে জড়িত।

শুক্রবার কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, শিবিরগুলোর রোহিঙ্গারা যেভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই বেশ মুশকিল হয়ে পড়বে। নিজ মোবাইল ফোনে শুক্রবার প্রাপ্ত একটি ভিডিও বার্তা দেখিয়ে পুলিশ সুপার জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরাই একে অন্যের ব্যাপারে নানা তথ্য সরবরাহ করে চলেছে। ওই ভিডিও বার্তায় বলা হয়েছে, শুধু টেকনাফের মুচনি (নয়াপাড়া) শিবিরের শালবাগানে নবী হোসেন বাহিনীর ২৩২ জন সদস্য রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে পাঁচ শতাধিক অস্ত্র।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, মিয়ানমার সরকার শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টির কাজে শুধু ইন্ধন নয়, রীতিমতো কাজ করছে। এপারে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই মিয়ানমার সরকারের অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।

কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন মনে করে, শরণার্থী নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক কিছু এনজিও এবং সংস্থার যোগসাজশে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কৌশলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দিয়ে রাখাইনে কথিত হামলার ঘটনা সৃষ্টি করে। আর এ ঘটনাকে পুঁজি করে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা অভিযান চালিয়ে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে উচ্ছেদ করে দেয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঠেকানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি করে দেওয়া, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো যায় যে তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।

আরও খবর