সলিমুল্লাহ খান :
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হইল জগদ্বিখ্যাত সুন্দরবনের অদূরে বাগেরহাট জেলার অন্তর্গত রামপাল নামক একটি জায়গায় কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ কারখানা বসাইবার আয়োজন চলিতেছে। এই বিদ্যুৎ কারখানা সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করিবে, তাহার অনুপম বিচিত্র প্রাণের অবসান ঘটাইবে এক কথায় ইহাতে সুন্দরবনের মৃত্যু হইবে। এই সত্যে সন্দেহ নাই বলিয়া দেশের বুদ্ধিজীবী মহল অন্তত ইহার একাংশ প্রতিবাদের হাত উঠাইয়াছেন। দুঃখের মধ্যে, এই প্রতিবাদ যাঁহারা সংগঠিত করিতেছেন তাঁহারা সংখ্যায় আর শক্তিতে বড় দুর্বল। নহিলে যতই দিন যাইতেছে তাঁহাদের প্রতিবাদও এইভাবে মিইয়া যাইত না। এই প্রতিবাদের সহিত আমি বরং জানাজার নামাজের তুলনা করিব। মানে বলিতেছি, যদি এই অবিমৃষ্যকারিতার বিরুদ্ধে দেশের কেহই কোথায়ও কোনো আওয়াজ না করিতেন আমরা এই যুগে যাহারা প্রাণধারণ করিতেছি তাহারা সকলেই দায়ী থাকিতাম। কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ কারখানা চালাইবার বিরুদ্ধে যাহারা প্রতিবাদ করিতেছেন আমি তাঁহাদের বন্দনা করি।
আপশোসের বিষয়, আমাদের প্রতিবাদ আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রামে পরিণতি পায় নাই। সর্বসাধারণের মধ্যে সত্য ঘটনার প্রচার না হইলে তাহা হইতেও পারে না। এই ধরনের কয়লা-বিদ্যুৎ কারখানার প্রকোপ ঘটিলে যাহাদের প্রথম শহিদ হইবার কথা আজিকালিকার নব্য দখলদারদের ভাষায় যাহাদিগকে বলা হয় ‘স্থানীয় জনসাধারণ’ তাহারাও খুব একটা বড় সংখ্যায় এই আন্দোলনে শরিক হন নাই। রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎ কারখানার প্রতিবাদীরা মোটের উপর গোটা দুইটা যুক্তি পেশ করিয়াছেন। একটা সামান্য, অন্যটা বিশেষ। সামান্য যুক্তি অনুসারে কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করা পৃথিবীর জীবজীবন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক। ইহাই জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা বিশ্বজনীন তাপমাত্রা বৃদ্ধির নিগূঢ় কারণ। প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবীরা যে বিশেষ যুক্তির আশ্রয় লইয়াছেন তাহার মর্ম মোতাবেক কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের কর্মটা যেন সুন্দরবনের আওতায় পড়ে এমন কোনো জায়গায় সম্পাদন করা না হয়। আন্দোলনটা যেন একান্ত সুন্দরবন বাঁচাইবার জন্য অন্য বনে নিষ্ঠীবন ছিটাইলে তাহাদের কিছু যাইবে কি আসিবে না।
১. কে জানে হয়তো শেষ পর্যন্ত এই বিশেষ যুক্তির আশ্রয় লইয়াছিলেন বলিয়াই আমাদের প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীগণ কক্সবাজার জেলার অধীনস্ত মহেশখালি দ্বীপে প্রায় আধাডজন কয়লা-বিদ্যুৎ কারখানা স্থাপনের বিরুদ্ধে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন নাই। করেন নাই বলিয়াই আমরা যে প্রবাদ হইতে জন্মিয়াছি আমাদিগকে শেষ পর্যন্ত সেই প্রবাদেই ফিরিয়া যাইতে হইতেছে। ইংরেজিতে যেমন বলে তেমন বলিতে হইতেছে কাঁটাটা কোথায় বিন্ধিতেছে তাহা মাত্র জুতা পরনেওয়ালাই জানে। হইতে পারে আমাদের হাতের এই ছোট্ট বহিটির লেখক দুইজনও মহেশখালিতে জন্মিয়াছেন বলিয়াই ঠাহর করিয়াছেন কাঁটাটা ঠিক কোথায়, কোন জায়গায়, বিন্ধিয়াছে। দুঃখের মধ্যে এই ভূমিকার লেখকও একই ভাগ্যের শরিক। আমিও এই অভাগা দ্বীপে একদিন ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলাম। এক্ষণে বলিয়া রাখা দরকার এই বইয়ের লেখকদ্বয় আমার নিকটতম আত্মীয় যথাক্রমে আমার সহোদর ভাই ও বোন। তবে মাত্র সেই কড়ারে আমি এই ভূমিকা লিখিতে বসি নাই। বয়সে কিছু ছোট হইলেও কি দায়িত্বজ্ঞানে, কি কর্তব্যনিষ্ঠায় কিংবা দূরদৃষ্টিযোগে তাঁহারা নিঃসন্দেহে আমার উত্তমর্ণ। তাঁহাদের বিষয়ে আমার বেশি কথা বলা হয়তো সমীচীন হইবে না। এই অবসরে মাত্র বলিতে পারি, শিক্ষাজীবনের দোরগোড়ায় ইহারা দুইজনেই মহাত্মা আহমদ ছফার সাহচর্য লাভ করিয়াছিলেন। আর কি বলিব, ইহাদের উদাহরণ হইতে আমি অনেক কিছু শিক্ষা করিয়াছি। আমাদের বাড়িতে যে কয়েকটি লেখক জন্মিয়াছেন তন্মধ্যে এই দুইজনই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্যের মধ্যে আমাদের হাতে ধরা ছোট্ট বহিটিই এই কথার প্রমাণ বিশেষ। কথাটা একটু বুঝাইয়া বলি। আমাদের দুই লেখক যে সকল প্রবন্ধ এই বহিতে একত্র করিয়াছেন তাহার সকল কথাই আমি বুঝিতে পারিয়াছি এমন দাবি করিব না। যেটুকু বুঝিয়াছি তাহার মধ্যে শুনিতে পাইতেছি এক তীব্র আর্তচিৎকার বিপন্নের বেদনা বা বোবাকান্না। অস্বীকার করিয়া লাভ নাই, আজিকার এই বিলুপ্তিসম্ভব একটি সামান্য দ্বীপে জন্মিয়াছিলেন বলিয়াই হয়তো তাঁহারা এই প্রতিবাদটা রচনা করিতেছেন। কিন্তু এই প্রতিবাদের একটি সামান্য তাৎপর্যও আছে। আমি বিশেষ করিয়া সেই কথাটার উল্লেখই করিতে চাই।
বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে ‘কাহারও পৌষমাস, কাহারও সর্বনাশ’। কথাটাকে আমাদের ভাষায় সম্প্রতি উদ্ভাবিত ‘উন্নয়ন’ নামক অপর একটি শব্দের সংজ্ঞা আকারেও গ্রহণ করা চলিবে। যত মানুষ এই পৌষমাসের বা ফসল তোলার আনন্দে আটখানা হইতেছেন ঠিক তত মানুষ কাহার কতখানি ‘সর্বনাশ’ সাধিত হইল তাহার হিসাব রাখিতেছেন কি? যাঁহারা রাখিতেছেন সেই অল্পসংখ্যক মানুষের চিন্তাভাবনা কিছু কিছু এই বইয়ের মধ্যে ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই আমার বিশ্বাস। এই বইয়ের বিষয়বস্তু মহেশখালি। একদিক হইতে দেখিলে বিষয়টাকে কিছু অসাধারণই মনে হইবে। সরকারি গেজেটের বাহিরে মহেশখালি বিষয়ে উল্লেখ করিবার যোগ্য বইপত্র বিশেষ লেখা হইয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। আরেক দিক হইতে বিচার করিলে দেখিবেন এই বিষয়টার সামান্য দিকও একটা আছে। কেননা আজিকালি সারা দুনিয়াতেই এই অভিজ্ঞতা ছড়াইয়া গিয়াছে। উন্নয়নের নামে মানুষ শুদ্ধ মানুষকেই উচ্ছেদ করিতেছে না, মানুষের মা
প্রকৃতিকেও খুন করিতেছে। ইহার পরিণতি চিন্তা করিবার অবসর তাহাদের নাই। বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন ব্যবসায়ের ফলাফল আজিকালি ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ নামে রাষ্ট্র হইতেছে। তবে ইহা মানুষের
প্রকৃতিকেও কতখানি বদলাইয়া দিয়াছে তাহার প্রকৃত হিসাব আজও নেওয়া হয় নাই। সাদাত উল্লাহ খান ও শাওয়াল খানের এই কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয় আপাতদৃষ্টিতে অকূলের কূল মহেশখালি নামের একটি বিন্দু। কিন্তু এই বিন্দুর মধ্যে একটি মহাসিন্ধুর কল্লোলও যাহারা কান পাতিবেন শুনিতে পাইবেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। সারা দুনিয়ায় কি ঘটিতেছে তাহা দেখিবার জন্য আপনাকে আজ বর্ধমান কি সিঙ্গাপুর যাইতে হইবে না। হয়তো মহেশখালি দেখিলেও চলিবে। আজ সারা দুনিয়া যেখানে কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল হইতে সরিয়া আসিতেছে সেখানে বাংলাদেশে একের পর এক খাল কাটিয়া জগতের যত ময়লা তত কয়লা আনা হইতেছে। বাংলা মুলুকের যে সকল ম-প এই মহাযজ্ঞের পীঠস্থান হইতে চলিয়াছে নাতিক্ষুদ্র মহেশখালি ও মাতারবাড়ী প্রভৃতি দ্বীপ তাহাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। শুদ্ধ একটা নহে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্তÑ গোটা পাঁচটা কয়লা-পোড়ানো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফাঁদ এক মহেশখালিতেই পাতা হইতেছে। ইহার একটা তাৎপর্য কাহারও পৌষমাস। আরেকটা তাৎপর্য কাহারও বা সর্বনাশ। প্রশ্ন হইতেছে, পৌষমাসটা কাহার আর কাহারই বা সর্বনাশ!
২. বর্তমানে মহেশখালির অন্তর্গত তিনটি দ্বীপ সোনাদিয়া, মহেশখালি ও ধলঘাট-মাতারবাড়ী ন্যূনাধিক তিন হইতে সাড়ে তিন লাখ মানুষের বাসভূমি। এতগুলি কয়লা-পোড়ানো বিদ্যুৎকেন্দ্র পাতানোর ফল এই সকল মনুষ্যসন্তানের জীবনে কী ফল বহন করিয়া আনিবে তাহা বুঝিবার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী হইবার আবশ্যক করিতেছে না। এই সকল দ্বীপে যাহারা আজও বসবাস করিতেছেন তাহাদিগকে একান্তে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই চলিবে। শুদ্ধ কি তাহাই? কথায় বলে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। আজ এই দ্বীপে বসানো হইতেছে কয়লার উপর তেলের ডিপো। একটার উপর আরটা। মহেশখালি দ্বীপের যেটুকু জায়গা পর্বতময় যেখানে বিচিত্র প্রকৃতি জীবনের বৈচিত্র্য আজও কিছুটা ধরিয়া রাখিয়াছেন সেখানেও আজ বিদেশ হইতে আমদানি করা তেল আর তরল করা
প্রাকৃতিক গ্যাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিয়াছে। কবুল না করিয়া উপায় নাই এই দুই সর্বনাশ নিশ্চয়ই কাঁহারও কাঁহারও ঘরে পৌষমাসের দানের ফসল তুলিতেছে। দুঃখের মধ্যে, আপনার সর্বনাশ সাধিত হইল। তবুও আপনাকে বলিতে হইবে এ সর্বনাশ সর্বনাশ নহে, এ সর্বনাশেরই অপর নাম যেন পৌষমাস। বর্তমানে এই করুণনাট্যের সর্বশেষ পালার অভিনয় করিতেছে কক্সবাজার জেলার অন্তঃপাতী মহেশখালি। একদা ইহার নাম ছিল আদিনাথ-মহেশখালি। ইহার ঘাটের নাম ছিল ‘গোরক্ষনাথের ঘাট’ অপভ্রংশে ‘গোরকঘাটা’। মহেশখালি একদা নাথধর্মের প্রান্ত স্পর্শ করিয়া থাকিবে। নহিলে ইহার নাম শিবের নামে হয় কি করিয়া! ইহাতেই প্রমাণ হাজার বছর আগেও এ দ্বীপে মানুষের বাস ছিল। আজ সেই বাস বিপন্ন।
বঙ্গদেশে ব্রিটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠার কিছু পরে ইংরেজি ১৭৯৮ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে স্কটদেশের ডাক্তার ফ্রান্সিস বুকানন ওরফে বুকানন-হ্যামিল্টন মহেশখালি পৌঁছিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন এই দ্বীপের দক্ষিণ দিকের এক জায়গায় তিনি বনের যুবরাজ বাঘের আনাগোনা আছে এমন প্রমাণ পাইয়াছিলেন। বুকানন শুনিয়াছিলেন মহেশখালির পাহাড়ে এই হিংস্র প্রাণীটি ছাড়াও অঢেল বন্য শূকরও পাওয়া যায়। অতিকায় প্রাণী হাতি প্রসঙ্গে তাঁহার বক্তব্য একসময় এই দ্বীপে হাতি দলের মুখোমুখি হওয়া ছিল নিত্য ব্যাপার। বুকানন জানাইতেছিলেন সেই যুগেই মহেশখালিতে হাতির বংশ লোপ পাওয়া শুরু হয়। তাঁহার ভাষ্য অনুসারে, ততদিনে কয়েক বছর হইল সর্বশেষ হাতির পালটির দেখা মিলিয়াছিল। (ফান শেন্দেল ২০০৮: ৪৪)
এখন এক কথায় বলা যায়, মহেশখালি দ্বীপটি মনুষ্যসন্তানের বাসভূমি পরিচয়ে অদূর ভবিষ্যতে বিলীন হইতেই চলিয়াছে। কয়লা কারখানায়, তেলের বিপণি বা শিল্পনগরীতে মানুষ থাকিবে কতটা আর কতটা না থাকিবে তাহা সংশয়ের বিষয়। তবে তাহা লইয়া কোনো কথা বলা চলিবে না। সম্মতি দিতে হইবে। কিন্তু কেন? আজিকালি শহরের মধ্যে কখনো প্রকাশ্য দিবালোকেও আপনাকে ডাকাতে যাহাকে বলে ছিনতাইকারীতে ধরিবে। ধরিবার পর সে বলিবে, ‘তোর যাহা আছে দিয়া দে, নইলে খুন করিয়া ফেলিব কিন্তু।’ আপনি যদি দয়া করিয়া তাহা দিয়াই না দেন তো তাহাকেই কষ্ট করিয়া খুন-খারাবির কাজটা করিতে হইবে। তাই সে আপনার সহায়তা চাহে। আপনি সহায় না হইলেও সে কিন্তু আপনার টাকাটা আপনার ‘যাহা কিছু’ লইবেই লইবে। তাহার লক্ষ্য আপনার টাকার থলিয়া। আপনি যদি ‘স্বেচ্ছায়’ থলিয়াটা তাহার হাতে তুলিয়া দেন তাহার দ্বিগুণ লাভ! টাকাটাও পাইল, আর আপনার সহায়তা বা সম্মতিটাও সে লইল। ইহাকেই কি বলে নিয়তি? বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপকূলে আরও দুইটি উল্লেখযোগ্য দ্বীপ আছে একটি সন্দ্বীপ, আরটি কুতুবদিয়া। প্রকৃতির করাল গ্রাসে পড়িয়া বহুদিন ধরিয়া এই দ্বীপ দুইটি ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর হইয়া যাইতেছিল। আর ঝাড়েবংশে বাড়িয়া চলিতেছিল মহেশখালি দ্বীপটি। নিয়তির কি মধুর পরিহাস আজ! এতদিনে মহেশখালির ‘উন্নতি’ দেখিয়া আমার হজরত ঈসার ছয় শত বৎসর আগেকার ক্ষুদ্র গ্রিক রাজ্য লিদিয়ার কথা মনে পড়িতেছে। প্রকৃতির রোষে যাহার শেষ হইল না, পুঁজির কোষে তাহার প্রয়াণ ঘটিল। একদা ক্ষুদ্র রাজ্য লিদিয়ার রাজা মিদাস দেবতার কাছে বর মাগিয়াছিলেন তাঁহার রাজ্যটি যেন সোনায় সোনায় ভরিয়া যায়। আর দেবতাও একদিন অপর্যাপ্ত পরিমাণে সেই বর মঞ্জুর করিলেন। বর দিলেন রাজা যাহাতেই হাত দিবেন তাহাই তাঁহার স্পর্শের জাদুতে সোনা হইয়া যাইবে। তাঁহার সিংহাসন সোনার হইল, সোনার খাট সোনার হইল। সোনার হইল ঘরের মেঝে, দরজার কপাট, খাবার থালাবাটি। যাহাই রাজা হাতে ছুঁইলেন তাহাই সোনার হইয়া গেল। এইক্রমে একদিন রাজার ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটি দৌড়াইয়া যেই রাজার কোলে বসিল অমনি হইয়া গেল ছোট্ট সোনার পুতুলটি। রাজা হায় হায় করিয়া উঠিলেন।
৩. পা-ববর্জিত মহেশখালি দ্বীপের গরিবগুর্বা কৃষক আর অধিক গরিব জেলে জনসাধারণ বহুদিন ধরিয়া কায়মনোবাক্যে তাহাদের দ্বীপের ‘উন্নয়ন’ প্রার্থনা করিতেছিলেন। ইতিহাস দেবতা আজ সেই প্রার্থনা পূরণ করিতেছেন। আহা কি অপর্যাপ্ত সেই পূরণ! এই ‘উন্নয়ন’ মহেশখালিকে জনশূন্য করিবে এ সত্যে সন্দেহ কি! আমাদের যে সকল পূর্বনারী ও পূর্বপুরুষ এই দ্বীপে একদা জীবনধারণ করিতে আসিয়াছিলেন তাহাদের কবরগাহ এখানেই পড়িয়া থাকিবে। এই কবরগাহ কোথায় যাইবে! আর আমরাই বা কোথায় যাইব! যেখানেই যাই না কেন, আমরা কি আর মুজফ্ফর আহ্মদের মতো কোনোদিন এই ধরনের কথা লিখিবার অবকাশ পাইব? ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মুজফ্ফর আহ্মদ। তিনি জন্মিয়াছিলেন বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনার মোহনায় ভাসমান ছোট্ট দ্বীপ সন্দ্বীপে। এই সুবাদে তিনি কখনো কখনো ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে নিজ রচনাদি প্রকাশ করিতেন। মহাভারত রচয়িতা বলিয়া খ্যাত মহামুনি ব্যাসদেবও ছিলেন একটি ‘দ্বৈপায়ন’। দ্বৈপায়ন ছদ্মনাম ছাড়িয়া আটাত্তর বছর বয়স্ক মুজফ্ফর আহ্মদ ১৯৬৭ সাল নাগাদ স্বনামে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা আজও আমার মনে গাঁথিয়া রহিয়াছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র একত্র হয়ে নিজ নিজ নাম বর্জন করে পদ্মা নাম নিয়েছে। এই পদ্মা আবার কত কত নদীকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরের কাছাকাছি সমুদ্র বিশেষে পরিণত হয়ে নিয়েছে মেঘনা নাম। মেঘনা পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। চট্টগ্রাম হতে বরিশাল পর্যন্ত মেঘনার মোহনা বিস্তৃত। এই মোহনায় সাগরে ভাসমান একটি ছোট্ট দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। হাজার বছর আগেও এই দ্বীপে মানুষের বসতি ছিল। সন্দ্বীপ বাদশাহী আমলের একটি পরগনা। নোয়াখালী জেলার স্থলভাগের বামনী প্রভৃতি জায়গা সন্দ্বীপ পরগনায় অবস্থিত। প্রশাসনিক ব্যাপারে দ্বীপটি আগে নোয়াখালী জিলায় ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার ক’বছর পরে তা চট্টগ্রাম জিলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাঙলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোনো এক সোমবারে আমি এই দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে জন্মেছি। (মুজফ্ফর ১৯৭১: ১) আমার কেন জানি বারবার মনে পড়িতেছে আজ হইতে পাঁচশত বৎসর আগেকার এক ইংরেজ সাধুর কথা। সাধু টমাস মোর তদীয় জগদ্বিখ্যাত ‘ইয়ুটোপিয়া’ গ্রন্থে ১৫১৬ সাল নাগাদ লিখিয়াছিলেন, ‘মাটিতে কবর লাভ করার সৌভাগ্য যাহার হয় না, আকাশই তাহাকে ঢাকিয়া রাখিবে।’ অধিক কি, আপনি কোথায় মরিবেন তাহাতে কি বা আসে যায়? ‘দুনিয়ার যে কোনো গ্রাম হইতেই আল্লাহর আরশের দূরত্ব সমান।’ (মোর ২০০৩: ১০)
২০ মার্চ ২০১৯। (সাদাত উল্লাহ খান ও শাওয়াল খান বিরচিত ‘মহেশখালি : উন্নয়ন, নীতি ও নিয়তি’ নামক প্রকাশিতব্য গ্রন্থের ভূমিকাস্বরূপে লিখিত।)
দোহাই
১.মুজফ্ফর আহ্মদ, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি : ১৯২০-১৯২৯, দ্বিতীয় মুদ্রণ (কলকাতা : ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭১)।
২. Thomas More, Utopia, Robert M. Adams, trans., George M. Logan and Robert M. Adams, eds., reprinted (Cambridge: Cambridge University Press, 2003).
৩। Willem van Schendel, ed., Francis Buchanon in South East Bengal (1798): His Journey to Chittagong, The Chittagang Hill Tracts, Noakhali and Comilla, 2nd impression (Dhaka: University Press Limited, 2008)
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-