মির্জা মেহেদী তমাল,বিডি প্রতিদিন
দেশের লাখ লাখ পরিবারে চলছে ইয়াবার দহন। ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষই ইয়াবার বিষে আক্রান্ত। ইয়াবার ছোবল শুধু কারও একটি জীবন বিষাক্ত করছে না, গ্রাস করছে একেকটি পরিবার। অবস্থা এমন হয় যে, একেকটি পরিবারে তৈরি হয় বিচ্ছেদের দেয়াল।
মা-বাবার আদরের সন্তান হয়ে যায় সবার চোখের বালি। ইয়াবায় আসক্তরা খুনখারাবিসহ জড়িয়ে পড়তে থাকে নানা অপরাধে। আর এই ‘ডার্টি পিল’ ইয়াবা বাংলাদেশে সহজলভ্য করেছেন টেকনাফের তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
যাদের ইয়াবা সাম্রাজ্যের তিন কুতুব বলা হয়ে থাকে। এই তিন কুতুবই মূলত ইয়াবাকে বাংলাদেশের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী কঠোর মাদকবিরোধী অভিযানেও তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এই তিন কুতুবের একজন হলেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। অপরজন জাফর আহমদ, যিনি টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান।
শেষজনের নাম সাইফুল করিম। যাকে আবার দেশের ‘নাম্বার ওয়ান’ ইয়াবা কারবারি বলা হয়। সাগরপাড়ে পুলিশের সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চারে যিনি রিসোর্ট তৈরি করেছেন। এই তিন কুতুব ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ইয়াবা পাচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। যে কারণে বিদেশ থেকেও এই বাণিজ্যে এখন অঢেল টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে নানা পর্যায়ে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ইয়াবা বিস্তৃতির এই নেপথ্যের তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ১০২ জন আত্মসমর্পণ করলেও ইয়াবার আগ্রাসন কমেনি। ইয়াবা পাচারের কলকাঠি তিন কুতুবের হাতেই। তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি মহলেও রয়েছে তাদের সরাসরি যোগাযোগ।
পাহাড়, নদী ও সাগরঘেরা নিসর্গ টেকনাফে মাছ চাষ, লবণ চাষ, কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন সেখানকার মানুষ। বাপ-দাদার আদি পেশাই ধরে রাখার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু এ নিয়ম পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিলেন এই তিন কুতুব। ইয়াবা নামক আলাদিনের চেরাগ তারা তুলে দিয়েছেন টেকনাফের সাধারণ মানুষের হাতে হাতে। ছোট চালান বিক্রিতেই অনেক লাভ! লোভে পড়তে শুরু করে মানুষ। চেরাগ ধরার গতি বেড়ে যায় তাদের। এ-ঘর থেকে ও-ঘর। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। ধুম পড়ে যায় ইয়াবা বিক্রির। অল্প দিনেই একজন লবণচাষি বনে যান কোটিপতি। ঠেলাচালকের হয় কোটি টাকার প্রাসাদ। আর সর্বনাশা এই ইয়াবা টেকনাফ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আসক্ত হয় ইয়াবায়। আর টেকনাফের সেই তিন কুতুব এবং তাদের পরিবার ইয়াবা বেচে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। ইয়াবা সাম্রাজ্যের এই তিন কুতুবের দুজন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা। অপরজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটি কোনো বাধা নয়। তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি তার ভাই আর বেয়াইদের নিয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে। রয়েছে তার অনেক ‘অনুসারী’। বদির আপন ভাই মো. আবদুল শুক্কুর, দুই সৎ ভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমান, বেয়াই শাহেদ কামাল, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল এবং ভাগ্নে নিপু আত্মসমপর্ণ করেছে। তবে আরেক ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান এবং মামা হায়দার আলী এখনো প্রকাশ্যে রয়েছে। জাফর আহমেদ এবং তার চার ছেলে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। এরা হলেন- শাহজাহান, ইলিয়াস, দিদারুল আলম ও মোস্তাক আহমদ। শাহজাহান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বড় ছেলে মোস্তাক আহমেদ রয়েছেন নিখোঁজ। দিদারুল আলম হলেন ১০২ জন আত্মসমর্পণকারীর একজন।
এক সময় ছাত্রদলের রাজনীতি করা সাইফুল ও তার পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামে অবস্থান করে সারা দেশের ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করছে। চট্টগ্রামে দেশের প্রধান এই ইয়াবা কারবারিকে শেল্টার দিচ্ছে চট্টগ্রামের সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। ওই নেতার প্রভাব খাটিয়ে হাজী সাইফুল ও তার পরিবার বহাল তবিয়তে থেকে বিস্তৃত করে যাচ্ছে তাদের ইয়াবা ব্যবসা। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার আশ্রয় পেয়ে সাইফুল করিম ও তার পরিবার এ কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সর্বশেষ তালিকায় বাংলাদেশে ইয়াবার এক নম্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে টেকনাফের শীলবনিয়া পাড়ার এই হাজী সাইফুল করিমকে। হাজী সাইফুল করিম সারা দেশে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে ‘এসকে’ নামেই পরিচিত। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিম এবং তার ভাই রেজাউল করিম, রফিকুর করিম, মাহাবুবুল করিম ও আরশাদুল করিম মিকি সারা দেশে সবচেয়ে বড় ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সাইফুল করিমের দুই শ্যালক-টেকনাফ বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান ও শ্রমিক দল নেতা আবদুর রহমানও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবার গডফাদারের তালিকায় এই দুজনের নামও রয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল নিজেকে টেকনাফ বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক বলে পরিচয় দেন। তার বৈধ ব্যবসার সাইনবোর্ডের নাম এসকে ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু গত ৯-১০ বছর ধরে এককভাবে ইয়াবা ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। সাইফুল করিমের ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল শক্তি হিসেবে রয়েছে তার মামা মিয়ানমারের মংডুর আলী থাইং কিউ এলাকার মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় দেখা গেছে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাঠান সাইফুলের মামা ইব্রাহিম ও তার অন্য সহযোগীরা। সাইফুল ও তার পরিবারের সদস্যরা মিয়ানমার থেকে এই ইয়াবা এনে সারা দেশে পাচার করেন। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ বলেন, তালিকায় আমার নাম থাকলেই কি আমি আত্মসমর্পণ করব নাকি। তালিকায় বদির নামও রয়েছে। আমরা অপরাধী নই। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সবাইকে সহযোগিতা করতে হয়। নইলে সমস্যা আছে।
তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীর সহযোগী হিসেবে আমার নাম রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইয়াবা বন্ধ হবে না। খোলা সীমান্ত। এখান দিয়ে ইয়াবা তো আসবেই। তিনি বলেন, প্রথমে একটা তালিকা হয়েছিল। ওটাতে আমার ছেলের নাম শত্রুতা করে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-