ইয়াবার টাকায় কক্সবাজার ক্যাম্প ছেড়ে বিদেশ যেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

অনলাইন ডেস্ক •  ইয়াবা পাচারের টাকায় পাসপোর্ট ও ভিসা সংগ্রহ করে কক্সবাজার শরনাথী শিবির থেকে বিদেশ যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা।

জানা যায়,কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে গত ১৬ জুলাই সন্দেহভাজন হিসেবে ফাতেমা বেগম নামে এক নারী আটক হন। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিতে এসেছিলেন তিনি। পাসপোর্ট অফিসের ভ্রাম্যমাণ আদালতে ২১ বছর বয়সী ওই নারী স্বীকার করেন তিনি ফাতেমা নন; তিনি ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে আসা সাওয়ানা আক্তার। দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর পৌঁছানোর জন্য দেড় লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।

সাওয়ানাকে বালুখালীর জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। আর পাসপোর্ট সংগ্রহে সহায়তাকারী তার বাবা পরিচয় দেওয়া ৭০ বছর বয়সী চকরিয়ার আমির হোসেনকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। কক্সবাজার সদর থানায় মামলাও হয়।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সাওয়ানা আক্তারের বাবা মৌলভি কামাল উদ্দিন। তিনি কক্সবাজার জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইয়াবা কারবারিদের একজন। ক্যাম্পে থাকা তার দুই ছেলে জমির উদ্দিন এবং জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে নিয়মিত নাফ নদ পেরিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বহনের অভিযোগ রয়েছে।

ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে মৌলভি কামাল ও জয়নাল এখন কারাগারে। জমির পলাতক। তবে সাওয়ানা ও মৌলভি কামাল যে বাবা-মেয়ে তা পুলিশ জানে না।

জামতলী বাজার হয়ে ১৫ নম্বর ক্যাম্পের শুরুতেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে জি/৩ ব্লকে মৌলভি কামালের ঘর। ব্লকের একজন রোহিঙ্গা তরুণ স্বেচ্ছাসেবী জানান, বাঁশের ঘরে আশ্রয় নেওয়া মৌলভি কামাল বেশ অর্থবিত্তের মালিক। ইয়াবার টাকায় বাংলাদেশি পাসপোর্টে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া গেছেন তার এক ছেলে ও সাওয়ানার স্বামী আব্দুর রহিম। গত সেপ্টেম্বরে আকাশপথে কুয়ালালামপুর যাওয়ার কথা ছিল সাওয়ানার। পাসপোর্ট অফিসে আটকা পড়ে এখন তিনি সাগরপথে স্বামীর কাছে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন।

গত ১৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদক যান সাওয়ানাদের ব্লকে। পাশের ঘরে থাকা নারী ও শিশুরা জানায়, আটক হয়ে হস্তান্তরের পর সাওয়ানা বাবার ঘরেই রয়েছেন। তবে সাওয়ানার মা সাবেকুন্নাহারের দাবি, পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সাওয়ানা কোথায় আছেন তা জানেন না তিনি। ছেলে ও মেয়ের জামাই মালয়েশিয়া যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেমন আমাদের কাছে বিদেশ, মালয়েশিয়াও বিদেশ। এতে অপরাধের কী আছে।

ক্যাম্প ব্লকের হেডমাঝি আইয়াজ আবেদীন বলেন, অনেক রোহিঙ্গা ২০১৭ সাল বা তারও আগে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবে গেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্যাম্প থেকে কেউ কেউ বিদেশগামী হওয়ার চেষ্টা করলেও আমরা নিরুৎসাহিত করছি।

সাওয়ানার বাবা পরিচয়দানকারী আমির হোসেনের বাড়ি চকরিয়ার মেধা কচ্ছপিয়ার পূর্ব হাজীপাড়ায়। তার মেয়ে পরিচয়ে সাওয়ানার পাসপোর্ট ফরমে ১৭ নম্বর খুটাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুর রহমানের সত্যায়ন ও জন্মনিবন্ধন সনদ রয়েছে। সাওয়ানা আক্তারের নামে ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ২২১১৬৬৭০০৪২৪২।

খুটাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট সত্যায়িত করলে জমির কাগজপত্র দেখায়। এখানে নয়-ছয়ের সুযোগ নেই। এর পরও জালিয়াতি হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বাবা-মা পরিচয়ে করাতে পারে। সে বিষয়েও সতর্ক আছি।

পাসপোর্ট জালিয়াতির ওই ঘটনায় করা মামলার বাদী জেলা পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী মো. সাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু তিনি জানেন না কক্সবাজার সদর থানায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কে বা তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু। রোহিঙ্গা নারীর বাবা পরিচয় দেওয়া আমির হোসেনের পরিবারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম মাসুম বলেন, এখানে স্থানীয়দের পাসপোর্ট প্রদানেও অনেকগুলো তদন্ত ও ধাপের মুখোমুখি হতে হয়। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সত্যায়নই যদি জাল করা হয়, সেটা আমরা প্রমাণ করব কীভাবে। তবুও ভাষা, চালচলন সন্দেহজনক হলে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

গত দুই বছরে সাওয়ানার স্বামী আব্দুর রহিমের মতো অনেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক দেশে। সন্দেহভাজন হয়ে কেউ কেউ বাংলাদেশ বা বিদেশের বিমানবন্দরে আটক হন। তবে কতজন এভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সেই হিসাব কারও কাছে নেই।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের একটি ছোট্ট অংশ কখনো নাফ নদ সাঁতরে বা বান্দরবানের গহিন পাহাড় হয়ে যাওয়া-আসা করে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনছে। ইয়াবা কারবারের টাকা জমা করে স্থানীয় দালালের সহায়তায় জাল-জালিয়াতি করে এদের অনেকেই অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। পাসপোর্ট না পেলে সাগরপথের ঝুঁকিতে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিচ্ছে দালালরা। মাঠপর্যায়ের দালাল বা বাহক আটক হলেও নেপথ্যের চক্রের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার আটক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়।

মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পড়ে পড়ে সাগরপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ২০১৫ সালে অনেকে মারা যান। পাচারের রুট থাইল্যান্ডের শঙ্খলা প্রদেশের বনাঞ্চলে আবিষ্কার হয় জিম্মিদশা ও পাচারকৃত মানুষের গণকবর। বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলা এই মানবপাচার রোধে প্রশাসন নজরদারি বাড়ায়। তবে ২০১৭ সালে নতুন করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা আসায় আবার বিদেশ গমনের তৎপরতা বেড়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কমিশনার মো. মাহবুবুর আলম তালুকদার বলেন, রোহিঙ্গারা মূলত ইয়াবার বাহক। এদের ভেতরে কিছু লোক আছে যারা অবৈধ এই টাকায় বিদেশগামী হতে চাচ্ছে, অপরাধে জড়াচ্ছে। আমরা রোহিঙ্গা মাঝিদের সঙ্গে মিটিং করে এসব অপরাধমূলক কর্মকা-ের বিষয়ে সচেতন-সতর্ক করছি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৭ জন মানবপাচারকারী নিহত হয়। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ২ জন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ১০-১৫ বছর বা তারও আগে রোহিঙ্গারা নানা উপায়ে অনেক দেশে পাড়ি দিয়েছে। এরাই তাদের আত্মীয়স্বজনকে সাগরপথ বা পাসপোর্ট করিয়ে টানছে। যাতায়াতের খরচ হিসেবে অনেক সময় প্রবাসীরা সহায়তা করে। রোহিঙ্গারাও মাদক বহন থেকে শুরু করে উদ্বৃত্ত ত্রাণ বিক্রির টাকায় খরচ মেটায়। পুলিশ এসব অপচেষ্টা প্রতিহত করছে।

আরও খবর