হিন্দু হয়েও বাবরি মসজিদের পক্ষে বুক চিতিয়ে লড়েছেন রাজীব ধাওয়ান


নিজের ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে বাবরি মামলায় ইনসাফ পাইয়ে দেয়ার জন্য তিনি লড়েছেন। পেয়েছেন খুনের হুমকি। চিঠি মারফত এসেছে সেইসব থ্রেট। শীর্ষ আদালতে ও আদালতের বাইরেও ছিল প্রাণ যাওয়ার ভয়। কিন্তু দমে যাননি ৭৪ বছরের রাজীব ধাওয়ান। সুপ্রিম কোর্টে ৪০ দিন ম্যারাথন শুনানির সময় অযোধ্যা মামলায় মুসলিম পক্ষের হয়ে প্রধান আইনজীবী হিসেবে শুনানি করেছেন রাজীব ধাওয়ান। সুপ্রিম কোর্ট ৯ নভেম্বর রায়ে জানিয়ে দিয়েছে, বাবরি মসজিদের জায়গায় হবে রামমন্দির। মুসলিমদের জন্য অয্যোধ্যার অন্যত্র ৫ একর জমি দেয়া হবে। এত লড়েও শেষ পর্যন্ত রায় গেছে বিপক্ষে। তাই বলে কি হেরে গেছেন রাজীব ধাওয়ান? না, হারেননি। হেরেও মানুষের দিল জিতে নিয়েছেন- তিনি ‘বাজিগর’।

চার দশকের বেশি সময় ধরে বাবরি মামলার সঙ্গে থাকা আইনজীবী জাফরইয়াব জিলানিও মুগ্ধ ধাওয়ানের প্রতি। শুনানির শেষ দিন মুসলিম পক্ষের আইনজীবী ধাওয়ান অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানের একটি ম্যাপ ছিঁড়ে ফেলেন। এটা নিয়ে মিডিয়ায় বেশ হইচই হয়। সাবেক আইপিএস অফিসার কিশোর কুনালের লেখা বই ‘অযোধ্যা রিভিজিটেড’- এ ছিল এই ম্যাপটি। এ নিয়ে জিলানি বলেন, আইনজীবী ধাওয়ান প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর অনুমতি নিয়ে এটি ছিঁড়েছিলেন। চলমান মামলার শুনানির সঙ্গে এই ম্যাপের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই হয়তো প্রধান বিচারপতি ছেঁড়ার নির্দেশ দেন। একশ্রেণির মিডিয়া এটি নিয়ে অহেতুক পানি ঘোলা করছে মন্দির নিয়ে মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করার জন্য।

রাজীব ধাওয়ানের নেতৃত্বে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবীরা একটা সুসংবদ্ধ দলের মতো লড়েছে অক্লান্তভাবে। ধাওয়ান সাহেবের শক্তিশালী ও ক্ষুরধার যুক্তি বারবার বিতর্কে পরাস্ত করেছে বিরোধী সওয়ালকারীদের। অনেক সময় মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্টের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে ক্ষমাও চেয়েছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস, ভ্রমণ-কাহিনি বা স্কন্দপুরাণের তথ্য বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা ঠিক করার জন্য প্রামাণ্য নথি হতে পারে না, উচ্চ আদালতে বারবার বলেছেন ধাওয়ান।

রাজীব ধাওয়ান বরাবরই যুক্তি ও প্রমাণের সঙ্গে সওয়াল করে এসেছেন, বাবরি শরিয়া অনুযায়ী একটি মসজিদ। ভেঙে ফেলেছে বলে ওটার মসজিদ চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় না। যেটা একবার মসজিদ, সেটা সবসময়ই মসজিদ। সেটা যদি পরিত্যক্ত হয়, কিছু দিন নামায বন্ধ থাকে তবুও সেটা অন্য কিছু হয়ে যায় না, মসজিদই থাকে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন রামের জন্মস্থান নিয়ে বিপক্ষের দলিল সম্পর্কে। রামের জন্মস্থান যে ওই বিতর্কিত স্থানেই, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণের দাবি তুলেছিলেন ধাওয়ান। রায় নিয়ে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। ভেবেছিলেন, তিনিই জিতবেন। কিন্তু, তাকে হতাশ হতে হয় রায়ে। নতুন সরকার আসে, আর ইতিহাস পাল্টানোর খেলা কেন শুরু হয়ে যায়, প্রশ্ন তুলেছিলেন এই লড়াকু আইনজীবী।

রাজীব ধাওয়ানের জন্ম ১৯৪৬ সালে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়ার পরকেমব্রিজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন । পড়িয়েছেন ইন্ডিয়ান ল ইনস্টিটিউট-সহ বিদেশের নামী প্রতিষ্ঠানেও। ১৯৯৪ থেকে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। ধাওয়ান ১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের কমিশনার নির্বাচিত হন। ২০০৯-এ হন এর এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারপার্সন।

আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে মানুষ খুন শুরু করলে তার তীব্র নিন্দা জানান এই আইনজীবী। তিনি ২০০৩-এ বলেছিলেন, আমেরিকার হামলা অনর্থক, অবিচারের নিদর্শন এবং আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করছে। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, কপিল সিব্বল, রাজিন্দর সাচার প্রমুখের সঙ্গে তিনিও এর নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে তিনিই এলাহাবাদ হাইকোর্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১০-এ এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিকে তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দিলে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, এটা পঞ্চায়েতের সালিশির মতো রায়। মুসলিমদের নায্য পাওনা হিন্দুদের আবেগের বলে আইনি অধিকার হয়ে গেল।

রাজীব ধাওয়ান বেশ কিছু বইও লিখেছেন আইন নিয়ে। এর মধ্যে Juristic Techniques in the Supreme Court of India 1950-1971 in Some Selected Areas of Public and Personal Law, The Supreme Court of India and parliamentary sovereignty: a critique of its approach to the recent constitutional crisis ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সারা জীবন ইনসাফের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু শেষ পর্বে এসে হয়তো তাকে হতাশ হতে হয়েছে। তিনি হেরে গিয়েছেন। কিন্তু, ভারতের গৌরবময় সমন্বয়বাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারেনি। বাবরি মসজিদের জন্য লড়েছিলেন রাজীব ধাওয়ান নামের এক হিন্দু- ইতিহাস সেটা অবশ্যই মনে রাখবে।
সূত্র : পূবের কলম