কক্সবাজারে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ

শাহীন মাহমুদ রাসেল •

রেল লাইন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা সমস্যা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, আবাসিক প্রকল্প, নগরায়ন ও নতুন নতুন জনপদ সৃষ্টিতে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। তৈরী হচ্ছে বসতবাড়ী, হাটবাজার, মার্কেট, সরকারী বে-সরকারী প্রতিষ্ঠান, এন.জি.ও, সামাজিক সংগঠন, স্কুল, মাদ্রসা, ইট ভাটা, অটো রাইসমিলসহ নানা প্রতিষ্ঠান, যার সব গুলোই তৈরী হচ্ছে আবাদি জমির উপর। কমে যাচ্ছে চাষের জমি, ফসল উৎপদন কমে যাচ্ছে ব্যাপক হারে। সেই সাথে বেড়েই চলেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেলো বিভিন্ন স্থানে তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে নির্মিত হচ্ছে এই সমস্থ প্রতিষ্ঠান, পাল্লা দিয়ে জমি ক্রয় করছে এন.জি.ও প্রতিষ্ঠান গুলো। কিছু দিন আগেও যত দূর চোখ যেত চোখে পড়ত সবুজ ফসলের মাঠ। কিন্তু এখন মাঠের দিকে তাকালে চোখে পড়বে নতুন নতুন ভবন।

গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমির সবচেয়ে বড় সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ইটভাটাগুলো। ১ থেকে ২ একর জমি ধ্বংস করেই এসব ইটভাটা গড়ে ওঠে। ইটভাটার জন্য মাটিও কেটে নেওয়া হয় আবাদি জমি থেকে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে ইটখোলা আছে ১ শত ৫০ টি। তবে জেলার ছোট-বড় মিলিয়ে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ২ শত। এসব ইটভাটায় বছরে অন্তত দেড় কোটি টন মাটি লাগে, যে কারণে বছরে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমি ২ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়া হয়। সারা জেলার বিভিন্ন জায়গায় মাছ চাষ একটি বৃহত্তম কৃষিভিত্তিক খামারে পরিণত হয়েছে। মাছের এ খামারগুলো গড়ে উঠেছে কৃষি জমিতে। বিভিন্ন উপজেলার আশপাশে যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বললে, তারা বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে গৃহায়ন, হাটবাজার, মিল ফ্যাক্টরী, তৈরী হওয়াতে আবদি জমির উপর ব্যাপক হারে চাপ পড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে জন সংখ্যা এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর আবাদি জমি খুজে পাওয়া দূস্কর হয়ে পড়বে।

কৃষি জমিতে বসত বাড়ি তৈরী করছে এমন একজন সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার ৪টি ছেলে সবার সংসার পৃথক হওয়ায় নতুন ঘর তৈরী করতে হচ্ছে। জেলার ভূমি অফিস জানায়, গত ২/৩ বছরে আবাদি জমি ব্যাপক হারে কমতে শুরু করেছে। কোন নিয়মনীতি না থাকায় আইন অমান্য করে এসব প্রতিষ্ঠান তৈরী হচ্ছে। সরকারী ভাবে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে আবাদি জমির পরিমান কমে গেছে কয়েক হাজার একর।

এক দিকে যেমন ফসলের জমি নষ্ট হচ্ছে অন্য দিকে অপরিকল্পিত ভাবে মিল কলকারখানা হওয়ায় পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে। বাড়ছে জনসংখ্যা বাড়ছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা চাহিদা, যার সবটাই আসে জমিতে উৎপাদিত পন্য থেকে। কিন্তু যে হারে জমি কমে যাচ্ছে সেই হারে জনসংখ্যা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সব সচেতন মহলেন গবেষণার ফলাফলেই কৃষি জমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া এবং অচিরেই বিপন্নতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিপন্নতা মোকাবিলায় সরকারের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। নেই আধুনিক বাস্তবসম্মত কোনো আইন।

স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসলি জমির ওপর। পরিবার বিভক্ত হলে তার প্রথম ধকলটিই পড়ে কৃষি জমিতে। এক বাবার চার সন্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা যায়। অনেকে চাকরির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি জমির কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এর পরও আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল। প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে সহস্রাধিক হেক্টর জমি। আবাসন ও নির্মাণকাজে চলে যাচ্ছে কমবেশি আরও তিন হাজার হেক্টর।

বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এখনই কৃষি জমি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

সব উপজেলার আশপাশের ভূমির চিত্র ঠিক একই রকমের। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার- টেকনাফসহ আশপাশের এলাকায় রয়েছে বিশাল বিশাল জলাশয়সহ কৃষি জমি। মাটি দিয়ে নির্বিচারে ভরাট করা হচ্ছে এসব জমি। অনেক জমি কেনার পর বাউন্ডারি করে রাখা হয়েছে।

যদি এই ভাবে চলতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে চাষি জমির আরো সংকট হবে। এবং খাদ্য উৎপদন ব্যহত হবে। সরকারী ভাবে একটি নীতিমালা তৈরী হওয়া উচিৎ এবং তা বাস্তবায়ন করলে এই সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।