চট্টগ্রামে বড়ুয়া ভবনে বিস্ফোরণ নিয়ে রহস্য

ডেস্ক রিপোর্ট • চট্টগ্রামের পাথরঘাটার বড়ুয়া ভবনে রোববারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণ এখনও রহস্যাবৃত। বিস্ফোরণের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। বিস্ফোরক পরিদফতর প্রাথমিকভাবে গ্যাস লাইনে লিকেজের কারণে বিস্ফোরণের কথা বললেও এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেননি কর্মকর্তারা।

তবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) বলছে, গ্যাস লাইনে কোনো ত্রুটি ছিল না। তারা বলেছে, সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিবিড় তদন্তের পর এ নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনও কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে তারা।

এদিকে বিস্ফোরণে নিহত ৭ জনের মধ্যে রিকশাচালক মাহমুদুল হকের স্ত্রী শাহিনা আক্তার দুইজন ভবন মালিকসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। এতে অবহেলাজনিত মৃত্যু ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগ করা হয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তদন্ত কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করলেও আরও কিছুটা সময় চেয়েছেন কমিটির সদস্যরা। এ বিস্ফোরণ নিয়ে নানা আলোচনা আছে। গ্যাস লাইনে লিকেজ বা সেপটিক ট্যাংক থেকে এ বিস্ফোরণ হয়েছে- এমন বক্তব্য নিয়ে সাধারণের মধ্যে সন্দেহ আছে। অনেকেই একে রহস্যজনক বলতে চাইছেন। নাশকতার জন্য ওই ভবনে বিস্ফোরক কিংবা কোনো দাহ্য পদার্থ মজুদ রাখা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।

রোববার পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডে বড়ুয়া ভবনে বিস্ফোরণে মা-ছেলেসহ ৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং স্কুলশিক্ষিকাসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। ভবনের সামনে মোতায়েন করা হয়েছে আনসার। চারপাশে উৎসুক মানুষের ভিড় লেগেই আছে।

বিস্ফোরক অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিদর্শক তোফাজ্জল সোমবার যুগান্তরকে বলেছেন, আমাদের প্রাথমিক ধারণা হচ্ছে গ্যাস লাইনে ত্রুটির কারণে এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ভবনের সামনের রাইজার ও পাইপ লাইন অনেক পুরনো এবং অরক্ষিত ছিল।

পাইপ লাইনের ফুটো দিয়ে গ্যাস বের হয়ে জমে থাকা এবং আগুনের স্পর্শে এমন দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে বিষয়টি তদন্তাধীন হওয়ায় চূড়ান্তভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। ফায়ার সার্ভিসও বিস্ফোরক অধিদফতরের এ বক্তব্যকে সমর্থন করেছে।

তবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এরই মধ্যে জমা হয়েছে। বিস্ফোরণের পর মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) প্রকৌশলী সারোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে উপ-মহাব্যবস্থাপক (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) প্রকৌশলী আহসান হাবিব, উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) প্রকৌশলী আবু জাহের এবং উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্লানিং) প্রকৌশলী শফিউল আলমকে নিয়ে কমিটি করা হয়।

গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত কমিটি রোববার রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, পরিচালক (অপারেশন) এবং কেজিডিসিএলের এমডির কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আ ন ম সালেহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একাধিক বিষয় বিশ্লেষণ করেছি। একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ, ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করেছি। গ্যাস লাইনে কোন ধরনের ত্রুটি খুঁজে পাইনি।’

যে কক্ষে বিস্ফোরণ হয়েছে ওই কক্ষের চুলার ওপর পাতিলের তরকারিও অক্ষত ছিল। দেয়ালে টাঙানো রশিতে ঝুলছিল কাপড়। একটি প্লাস্টিকের জিনিসপত্রও পুড়েনি। রান্নাঘরে গ্যাসের জিআই পাইপের লাইনও রয়েছে অক্ষত। এমনকি দুই ঘরের মাঝখানের দেয়ালটিও অক্ষত।

কোনোভাবেই এটি গ্যাস লাইন লিকেজের অগ্নিকাণ্ড নয়। এখানে আগুনটা ছোট, বিস্ফোরণটা বড়। আমাদের উচিত বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করা। এদিকে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। সোমবার কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এজেডএম শরিফ হোসেন ছাড়া অন্য সদস্যরা হলেন- ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), সিডিএ ও পুলিশের একজন প্রতিনিধি।

শরিফ হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। এখনই কারণ বলা সম্ভব নয়। গ্যাস লাইন লিকেজ নাকি সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণ না অন্য কোনো কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে- সব বিষয় আমলে নিয়েই তদন্ত চলছে।’

ভবন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা : নিহত রিকশাচালক মাহমুদুল হকের স্ত্রী শাহিনা আক্তার ভবন মালিক অমল বড়–য়া ও টিটু বড়–য়ার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চাকমা সোমবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেছেন, নিহত মাহমুদুল হকের স্ত্রী বাদী হয়ে ৩০৪/ক ধারায় বা অবহেলাজনিত মৃত্যু ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগে মামলা করেন।

জ্ঞান ফেরেনি স্কুলশিক্ষিকা তিশা গোমেজসহ ৩ জনের : চট্টগ্রাম ব্যুরোর এমএ কাউসার জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি তিনজনের জ্ঞান ফেরেনি ২৪ ঘণ্টা পরও।

এর মধ্যে পাথরঘাটা সেন্ট জনস গ্রামার স্কুলের শিক্ষিকা তিশা গোমেজ বিস্ফোরণের সময় স্কুলে যাওয়ার পথে দেয়ালচাপায় গুরুতর আহত হন। আইসিইউতে থাকা প্রত্যেকের মাথা ও বুকে গুরুতর আঘাত রয়েছে। তিশার বাবা অনল গোমেজ বলেন, ‘আমার স্বপ্নটা বুঝি আর পূরণ হল না। ২৪ নভেম্বর তিশার বিকম ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা।

সৃষ্টিকর্তা যদি তাকে বাঁচায়, সে কীভাবে লেখাপড়া করবে। তার তো ডান হাতই ভেঙে গেছে!’। আইসিইউতে থাকা অপর দুইজন হলেন- নজির আহম্মদ (৫৫) ও আবদুল হামিদ (৩৫)। এর মধ্যে নজির আহম্মদ ঘটনার সময় রিকশা চালিয়ে এবং আবদুল হামিদ পথচারী হিসেবে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের দেয়ালচাপায় তারা আহত হন।

আইসিইউর দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, তিনজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। কারও জ্ঞান ফেরেনি। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত নয়জনের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ একজনকে রোববার বিকালেই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। তার নাম অর্পিতা নাথ (১৫)।

অর্পিতা নগরীর অর্পণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিস্ফোরণে তার মুখমণ্ডল এবং শ্বাসনালি পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। এদিকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নয়জন আহতের মধ্যে চারজনকে ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে, একজনকে অর্থোপেডিক্স বিভাগে এবং অর্পিতা নাথকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।