আন্তর্জাতিক ডেস্ক ◑ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যা মামলার শুনানিকে সামনে রেখে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি শুরু হওয়ার আগেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠাতে চায় দেশটি। ওই প্রতিনিধিদলের সফরের আয়োজনের অনুরোধ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে মিয়ানমার।
ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে মিয়ানমার বিশ্বকে দেখাতে চাইছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে তারা তৎপর। অতীতে জাতিসংঘে কোনো আলোচনা কিংবা বৈঠকের আগে তারা এ ধরনের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছে। এবারও একই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের সরকারি কর্মকর্তাদের পাঠানোর পাশাপাশি রাখাইনে নৃশংসতার জন্য গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশনের (আইসিওই) একটি প্রতিনিধিদলকেও বাংলাদেশে পাঠাতে চাইছে। ওই কমিশনকে কক্সবাজার সফরের অনুমতি দিতে সম্প্রতি প্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী দেশ বাংলাদেশকে কয়েকবার অনুরোধও করেছে।
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আইসিজেতে ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া। এতে সমর্থন দিয়েছে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যার মামলার শুনানি আগামী ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১২ তারিখ হতে যাচ্ছে। শুনানির আগেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়া একটি সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার।
নাম না প্রকাশের শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সফরের প্রস্তাবের সঙ্গে আইসিজের শুনানির যে সম্পর্ক আছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
প্রায় দেড় বছর আগে মিয়ানমার সরকারের গড়া স্বাধীন তদন্ত কমিশনের (আইসিওই) ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্ন আছে। ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রোজারিও মানালোর নেতৃত্বাধীন এই কমিশনটিকে মিয়ানমার সরকারের নির্দেশিত বলে ধরা হয়। কারণ, এখন পর্যন্ত ওই কমিশন মাত্র একবার সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে রাখাইনে গেছে। কক্সবাজারের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বক্তব্য জানতে চায়নি। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরুর পর থেকে ওই কমিশন মূলত নিজেদের মধ্যে বৈঠক, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং, স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সময় পার করেছে।
গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানির আগেই রোহিঙ্গা শিবিরে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠাতে চায় মিয়ানমার।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের আন্তরিকতার বিষয়টি এর মধ্যেই প্রমাণিত। আর মিয়ানমার বারবার কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিশ্বকে বারবার বোকা বানানোর অপচেষ্টা করেছে। মিয়ানমারের যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, সেটা স্পষ্ট। এখন আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের প্রক্রিয়া মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তাচৌকিতে সন্ত্রাসীদের হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নৃশংসতা শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরের কয়েক মাসে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ এই নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম দফা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ১৫ নভেম্বর। কিন্তু রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো পরিবেশ না থাকায় প্রত্যাবাসন হয়নি। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় চলতি বছরের ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের আরেকটি তারিখ ঠিক হয়েছিল। কিন্তু রাখাইনের পরিবেশ রোহিঙ্গাদের ফেরার উপযোগী করতে পারেনি মিয়ানমার। ফলে এবারও প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়।
প্রত্যাবাসন নিয়েও মিয়ানমারের মিথ্যাচার
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের ওপর দায় চাপানো থেকে সরছে না মিয়ানমার। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারকে মিথ্যাচার বন্ধ করতে বলেছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মুখপাত্রের বক্তব্যের প্রতিবাদে গত রোববার প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ এ দাবি করেছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মুখপাত্রের বক্তব্যের ৯ দিন পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানাল।
১৫ নভেম্বর নেপিডোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না।
মিয়ানমারের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অযৌক্তিক ও মিথ্যা দাবি করে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির যে দায়িত্ব মিয়ানমারের রয়েছে, সেটি তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-