আহমদ গিয়াস ◑
সমুদ্র সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালিকে আটকে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির মূল কারিগর হিসাবে পরিচিত সাগরলতা। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূলে ঠেকিয়ে রাখে বলে বালিয়াড়িকে সৈকতের রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দখল ও দূষণের শিকার হয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
সৈকতে বালিয়াড়ি তৈরির মূল কারিগর সাগরলতা স্থানীয়ভাবে ডাউঙ্গা লতা নামে পরিচিত। কেউ কেউ গঙ্গালতা, কেউ পিঁয়াজলতা নামেও ডাকে। এর ইংরেজি নাম রেলরোড ভাইন, যার বাংলা দাঁড়ায় রেলপথ লতা। রেলপথের মতোই এর দৈর্ঘ্য। একটি সাগরলতা ১শ ফুটের বেশি লম্বা হতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ওঢ়ড়সড়বধ ঢ়বং পধঢ়ৎধব. উন্নত বিশ্ব সৈকতের পরিবেশগত পুনরুদ্ধারে সাগরলতার বনায়নের মাধ্যমে বালিয়াড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু এ নিয়ে বাংলাদেশে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. কামাল হোসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সৈকতের হ্যাস্টিং পয়েন্টে সাগরলতার মাধ্যমে বালিয়াড়ি সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দেখানো পথে সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধ ও সংকটাপন্ন পরিবেশ পুনরুদ্ধারে বিশ্বের দেশে দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে সাগরলতাকে।
উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্ধ ফলাফলে সাগরলতার মতো দ্রাক্ষালতা সৈকত অঞ্চলে পরিবেশগত পুনরুদ্ধার ও মাটির ক্ষয়রোধের জন্য একটি ভালো প্রজাতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাগরলতা ন্যূনতম পুষ্টিসমৃদ্ধ বেলেমাটিতে বেড়ে উঠতে পারে। পানির প্রয়োজনীয়তা কম। উচ্চ লবণাক্ত মাটিও এর জন্য সহনশীল। এর শিকড় মাটির ৩ ফুটের বেশি গভীরে যেতে পারে। এটি দ্রুত বর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। বাইরের হস্তক্ষেপ না হলে লতাটি চারদিকে বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ সামুদ্রিক জোয়ারের উপরের স্তরের বালিয়াড়িতে জাল বিস্তার করে মাটিকে আটকে রাখে। এরপর বায়ুপ্রবাহের সাথে আসা বালি ধীরে ধীরে সেখানে জমা হয়ে মাটির উচ্চতা বৃদ্ধি করে। এতে সাগরলতার ও সৈকতের মাটির স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
কক্সবাজারের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মতোই বড় বড় বালির ঢিবি ছিল। এসব বালিয়াড়ির প্রধান উদ্ভিদ ছিল সাগরলতা। সাগরলতার গোলাপি-অতি বেগুনী রঙের ফুলে সৈকতে অন্য রকমের সৌন্দর্য তৈরি হতো। কিন্তু সাগরলতা ও বালিয়াড়ি হারিয়ে যাওয়ায় গত ২৮ বছরে কক্সবাজার সৈকতের ৫শ মিটারের বেশি ভূমি সাগরে বিলীন হয়ে সাগর এগিয়ে এসেছে।
বালিয়াড়িকে সৈকতের রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বালিয়াড়ির কারণে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস লোকালয়ে তেমন ক্ষতি করতে পারে না।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়েও সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়ির পাশে থাকা মসজিদসহ আশপাশের বাড়িঘর ছিল নিরাপদ। সেখানে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যেমন উঠেনি, তেমনি বাতাসের তোড়ও ছিল কম। ফলে বাড়িঘরগুলো ছিল নিরাপদ। অথচ যেখানে বালিয়াড়ি ছিল না সেখানে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বাড়িঘর তলিয়ে দেয় বলে জানান শহরের বাহারছড়ার বাসিন্দা হাজী আবুল শামা।
বালিয়াড়িকে কক্সবাজার অঞ্চলে ডেইল বলা হয়। কক্সবাজার উপকূলের কুতুবদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত এই ধরনের বহু বালিয়াড়ি দেখা যেত। সমুদ্রতীরের বাসিন্দারা এই ধরনের বালিয়াড়ি ঘিরে লোকালয় তৈরি করে। আর এ লোকালয়গুলো ‘ডেইলপাড়া’ নামে পরিচিতি পায়।
যেমন কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কক্সবাজার শহরের ফদনার ডেইল, উখিয়া জালিয়াপালংয়ের ডেইলপাড়া, টেকনাফের মুন্ডার ডেইল ও সেন্টমার্টিনের ডেইলপাড়া অন্যতম।
কক্সবাজার জেলায় ডেইলকেন্দ্রিক অনেক লোকালয় রয়েছে। একসময় কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে কলাতলী পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫শ ফুট চওড়া একটি ডেইল ছিল। এই ডেইলের কোনো কোনো স্থানে উচ্চতা ৩০ ফুটেরও বেশি ছিল। যেখানে থরে থরে ফোটা সাগরলতার ফুল দেখা যেত। তা দেখে চোখ জুড়াত পর্যটকদের। কিন্তু এসব বালিয়াড়ি ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা। ফলে এখন আর শহরের কোথাও সাগরলতা তেমন দেখা যায় না। তবে শহরের বাইরে যেখানে কিছু বালিয়াড়ি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, সেখানে টিকে আছে সাগরলতা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. কামাল হোসেন জানান, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে ২ দশক আগেও বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি দেখা যেত। এসব বালিয়াড়ি ঘিরে সাগরলতাসহ নানা লতা-গুল্ম ও উদ্ভিদরাজি গড়ে উঠত। এসব উদ্ভিদরাজিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্রও। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং দখল-দূষণের কারণে সমুদ্র তীরের বালিয়াড়িগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে সাগরলতাও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর বালিয়াড়িগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে বলে জানান কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা ও কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা। তিনি বলেন, বালিয়াড়িগুলো কী কারণে হারিয়ে গেছে তা নিয়ে গবেষণা এবং হারানো পরিবেশ পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সমুদ্র বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল হক বলেন, সাগরলতা একটি চিরসবুজ উদ্ভিদ। মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খোলা সৈকতের দিকে এটাকে বাড়তে দেখা যায়। এটি ৩০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৩০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় সমস্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। সাগরলতার অগ্রবর্তী অংশ সৈকতের সীমানা চিহ্নিতকারী শুষ্ক, লবণাক্ত এবং বালুকাময় তীরে বৃদ্ধি পায়। এই উদ্ভিদটি সৈকতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এর বেশিরভাগ অংশ এমন অঞ্চলে আবৃত হয়, যাতে ঘন বন তৈরি করে।
তিনি জানান, দরিয়ানগরে ছোট্ট পরিসরে চালানো একটি বেসরকারি প্রাথমিক গবেষণায়ও সাগরলতার সাহায্যে বালিয়াড়ি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। সাগরলতার পাতা ক্ষারযুক্ত যৌগ উৎপাদন করে। ফলে কোনো প্রাণী সাগরলতা খায় না। পোকামাকড় থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে নাইট্রোজেনযুক্ত যৌগ উৎপাদন করে। সাগরলতা গাছ ও ফুলে ঔষধি গুণ থাকায় সমুদ্র সৈকত রক্ষার পাশাপাশি মানবকল্যাণেও এর ব্যবহার করা যায়। সাগরলতার পাতার রসে জেলিফিশের আক্রমণে সৃষ্ট স্টিং রোগ নিরাময় হয়।
এ বিষয়ে কক্সবাজার উপকূলের বাসিন্দা ও জেলে সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত জ্ঞান রয়েছে। উপকূলে মাছ ধরতে গিয়ে কোনো জেলে জেলিফিশ বা হউস মাসের লেজের আক্রমণের শিকার হলে তারা সাগরলতার পাতার রস ক্ষতস্থানে ব্যবহার করে। এতে সাথে সাথে ক্ষতের যন্ত্রণা বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষতস্থান শুকিয়ে যায়। কিন্তু কোনো ওষুধ ব্যবহার করা না হলে সেই ক্ষতস্থানে সংক্রমণ ঘটে ও পচন ধরে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সৈকতে বেড়ে ওঠা সাগরলতায় প্রথমে সাগর থেকে ভেসে আসা কাঠের খণ্ড, বীজসহ আবর্জনা আটকা পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে আটকা পড়ে বালি। এভাবে বালিয়াড়ির উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সাগরলতা একবার প্রতিষ্ঠিত হলে কোনো পরিপূরক জলের প্রয়োজন পড়ে না। তবে এই উদ্ভিদের জন্য পূর্ণ সূর্যালোক দরকার। প্রায় সারা বছরই ফুল ও ফল দেয়। প্রজাপতির জন্য এক অমৃত গাছ হিসাবে পরিচিত সাগরলতায় ভোরে মৌমাছিও বসে।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, সৈকতের বালিয়াড়িতে সাগরলতা যখন স্থিতিশীল হয়, তখন সেখানে ঘাসসহ অন্যান্য উদ্ভিদ জন্মায়। এতে তীর আরো টেকসই হয় এবং সৈকতের পাখিসহ প্রাণীকূলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। সৈকতের একটি অগ্রণী প্রজাতি হিসাবে বন্যজীবন এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য সাগরলতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আদর্শ প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
সাগরলতা সৈকতের অন্যান্য প্রাণী, যেমন বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া ও পাখির টিকে থাকার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। সাগরলতার সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত করতে না পারে। এতে মাটির নিচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য প্রাণীকূলের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। তাই বালিয়াড়ি ও সাগরলতা না থাকলে আরো বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, কক্সবাজার সৈকতের সৌন্দর্যমানকে সুসজ্জিত করতে হলেও সাগরলতা দরকার। সমুদ্র সৈকত না থাকলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পও টিকতে পারবে না। তাই পর্যটনের স্বার্থে বালিয়াড়ি ও বালিয়াড়ি উদ্ভিদ রক্ষার মাধ্যমে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজন।
ভূ-তত্ত্ববিদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী জানান, ভূ-পৃষ্ঠের পাহাড় বা নদীতীরবর্তী বেড রক (খারাপ পাথর) থেকে কোয়ার্টজ কণাগুলি ক্ষয়ে গিয়ে এবং সাগরে অবস্থিত বিভিন্ন ঝিনুক-শামুক জাতীয় প্রাণীর শরীরের ভেঙে যাওয়া কণা থেকে বালি তৈরি হয়। পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা ভূ-পৃষ্ঠের বালি সমুদ্র মোহনায় জমা হয়ে এবং সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে আসা প্রাণিকণা সৈকতে জমা হয়ে তীর গঠন করে। সেই তীরে উদ্ভিদ গজিয়ে উঠে বালিয়াড়ির সৃষ্টি হয়। এভাবে সমুদ্রে বিভিন্ন দ্বীপও তৈরি হয়। কক্সবাজারের সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন ও ধলঘাটাসহ দেশের বিভিন্ন দ্বীপ এভাবেই বালিয়াড়ি সৃষ্টির মাধ্যমে গঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপ কিংবা সৈকতে সৃষ্ট বালিয়াড়ির স্থিতিশীলতার জন্য যে উদ্ভিদটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেটি হলো সাগরলতা। বালিয়াড়ি আর সাগরলতা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-