রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

অনলাইন ডেস্ক ◑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বছর ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। স্পেনের মাদ্রিদে কপ-২৫ নামে পরিচিত ২৫তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিলডা হেইনি দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করলে বাংলাদেশের সরকার প্রধান তা গ্রহণে সম্মতির কথা জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন এ তথ্য জানান। বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সবাই যদি চায় তাহলে তিনি এ দায়িত্ব নেবেন। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের সময় মালদ্বীপ সরকার সিভিএফ গঠন করে। মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হেইনি বর্তমানে সিভিএফ-এর সভাপতি। এই ফোরামের কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতার নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করা। কেননা এই উষ্ণতার ফলে আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষতি হয়।

সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করুন- প্রধানমন্ত্রী: এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশের আরো অবনতি রোধকল্পে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্যারিস চুক্তির সকল ধারাসহ প্রাসঙ্গিক সকল বৈশ্বিক চুক্তি ও প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ-২৫)-এর সাধারণ গোলটেবিল আলোচনায় সোমবার বলেন, জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যর্থতার ফল সকল দেশের ওপর সমানভাগে, বিশেষ করে যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বেশি দায়ী তাদের ওপর বর্তাবে। আমাদের নিষ্ক্রিয়তা প্রত্যেক জীবিত মানুষের জন্য হবে মারাত্মক। এটি ঠেকাতে পদক্ষেপ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা নেতৃবৃন্দ এবং রাজনীতিকদের দায়িত্ব উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক কিছু করতে পারি না। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের কপ-২৫ মাদ্রিদে হচ্ছে। সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে সকল আলোচনায় ‘লস এন্ড ডেমেজ’ নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে লস এন্ড ডেমেজ অর্থায়ন বিবেচনায় ‘ওয়ারস’ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজমকে আরো জোরালো সমর্থন দিতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নের বৈশ্বিক চিত্রপট খুবই সমন্বয়হীন, জটিলতাপূর্ণ ও অত্যন্ত অপ্রতুল। শেখ হাসিনা বলেন, প্যারিস চুক্তিতে ‘অভিন্ন কিন্তু পৃথকীকৃত দায়িত্ব’-এর নীতির ভিত্তিতে বিশেষ পরিস্থিতি এবং স্বল্পোন্নত দেশসমূহ ও ‘বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহ’-এর প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়নের প্রত্যেক সরবরাহ প্রক্রিয়ায় এই স্বীকৃতি মেনে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্যারিস চুক্তির কাঠামো ও বাস্তবায়নের আলোকে সমতা অথবা স্বচ্ছতার ধারণা একটি মৌলিক ইস্যু, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সহযোগিতায় এই চুক্তির সুফল অর্জিত হতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সভ্যতার ক্ষতি করছে এবং পৃথিবীকে ধ্বংস করছে। এটি বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের অস্তিত্বের জন্য এখন হুমকি সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছি। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আন্তঃসরকার প্যানেলের ৫ম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিষয়টি পরিস্কার তুলে ধরা হয়েছে, যে বর্তমান শতাব্দির পুরোটাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অব্যাহত থাকবে। আমরা কাবর্ন নিঃসরণ বন্ধ করতে না পারলে অথবা কমাতে না পারলে আমাদের ধংসের মুখামুখি হতে হবে। পরিস্থিতি পয়েন্ট অব নো রিটার্ন-এর দিকে দ্রুত ধাবমান হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের এখন সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব হ্রাস করা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ বন্ধে সক্ষমতা অর্জন করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশ সর্ববৃহৎ ডেল্টা। আমরা যদি এটিকে হালকা করে দেখার চেষ্টা করি তা হলে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের বিপুলসংখ্যক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই হার ৯ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বিশ্ব ব্যাংক ও ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব বন্ধ করা না গেলে আমরা কখনোই এসডিজি অর্জন এবং দারিদ্র্য নির্মূল করতে পারবো না। তিনি বলেন, সম্পদের স্বল্পতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তাঁর স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ব-দ্বীপ অঞ্চলে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ-সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডের সহায়তায় ডেল্টা প্লান ২১০০ প্রস্তুত করেছে। বাংলাদেশই প্রথম এলডিসি দেশ যে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার ৬৪ জেলার সবকটিতে সেক্টরভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও অনুশীলন ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও অনুসরণযোগ্য হচ্ছে।

প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে নেদারল্যান্ডসের প্রতি আহ্বান: ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে নেদারল্যান্ডস সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কপ-২৫ এর সাইড লাইনে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে তিনি এ আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, আগামী সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শুনানিতে যোগ দিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি নেদারল্যান্ডস সফর করবেন। সে সময় নেদাল্যান্ডসের উচিত হবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধানও তাদেরই করতে হবে। তিনি মার্ক রুটেকে বলেন, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী এবং বন্ধুপ্রতীম দেশ। তারা সবসময়ই বলে আসছে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবে। তারা কখনোই বলেনি যে, ফেরত নেবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনারা সহায়তা করতে পারেন। ১১ লাখ রোহিঙ্গা আগমনের কারণে কক্সবাজারের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ভাসানচর নামে একটি দ্বীপে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের স্থানাস্তরের জন্য দ্বীপটির উন্নয়ন করেছে। বাংলাদেশের সরকার প্রধান রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে সোচ্চার হওয়া এবং রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তা দানের জন্য নেদারল্যান্ডসকে ধন্যবাদ জানান।

ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ, সেনা প্রধানের মিয়ানমার সফরসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা: মাদ্রিদে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। কপ-২৫ এর সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত সেই সাক্ষাৎ-বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুততর করতে ইউরোপের রাজনৈতিক সমর্থন চান। একই সঙ্গে ইস্যুটি নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনার কথাও জানান। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে চীন, ভারত, জাপান এবং থাইল্যান্ড বাংলাদেশের সঙ্গে একমত এবং এ ব্যাপারে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তারাও বলছে, রোহিঙ্গাদের উচিত তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি মিয়ানমারের উচিত আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা। কারণ আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আঞ্চলিক শান্তি চাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মিয়ানমার সফর করবেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সকল পর্যায়ে বাংলাদেশ সহযোগিতা ও যোগাযোগ করে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, এর বিরুদ্ধে তাঁর সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। অন্য দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কাউকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন।