রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে ফের সক্রিয় মানবপাচারকারী চক্র

আব্দুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন ◑


কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ মানবপাচারকারী কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা ফের জড়িয়ে পড়ছে মানব ও ইয়াবা পাচারে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে সাগরপথে মানবপাচার বন্ধ থাকলেও এ বছর শুষ্ক মৌসুম আসার পর আবারও পাচার বেড়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে পাচারকারীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, জামিনে মুক্তি নিয়ে অনেক পাচারকারী এতদিন আত্মগোপনে ছিল। শীত আসার পর তারা উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ফিরে আবারও মানবপাচার শুরু করেছে। এদের অনেকেই নির্ভয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও একাধিক মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা ক্যাম্প থেকে মালয়েশিয়ায় যেতে আগ্রহী নারী-পুরুষ সংগ্রহ করছে এবং রাতের আঁধারে নৌকায় তুলে দিচ্ছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৩৫৫ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ৬১৭ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় পাচারে জড়িত ১৭ জন দালালকে আটক করা হয়। একইভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৮টি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্রমতে, ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ বছরে মানবপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২ হাজার ৭০৬ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার মানবপাচারের একটি তালিকা তৈরি করে। তারা সেটি পুলিশের ঢাকা হেডকোয়ার্টারের স্পেশাল ক্রাইম অ্যান্ড প্রসিকিউশনে পাঠায়। এতে ১১ জন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী, ২৬ জন হুন্ডি ব্যবসায়ী ও কক্সবাজারসহ সারাদেশের ২৩০ জনকে নিয়ে প্রায় ৩০০ মানবপাচারকারীকে চিহ্নিত করা হয়। ওই তালিকায় কক্সবাজার জেলার বাঘা বাঘা প্রায় ৫০০ মানবপাচারকারীর নাম বাদ পড়ে যায়।

জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ৪৬১ জনের একটি তালিকা নিয়ে মানবপাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট। ওই সময় কক্সবাজারের সব ব্যাংকের শাখায় চিঠি পাঠিয়ে ৪৬১ জনের অ্যাকাউন্টের তথ্য নিলেও এর কোনও সুরাহা হয়নি। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা।

সহজে মুক্তি পাচ্ছে পাচারকারীরা

মানবপাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও পাচারকারীদের বিপক্ষে তেমন কোনও সাক্ষী বা প্রমাণ না থাকায় তারা কারাগার থেকে সহজে জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলাকেও এর জন্য অনেকে দায়ী করছেন।

কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মানবপাচারের মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মামলার তদন্তে পুলিশের সীমাহীন দুর্বলতা রয়েছে। এছাড়াও মামলার সাক্ষী ও ভিকটিমের সাক্ষ্যগ্রহণের অভাবে অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। ভবিষ্যতে এসব মামলার কোনও ভিত্তি দেখা যাচ্ছে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রহিম জানান, মানি লন্ডারিং আইন-২০১২-এর একটি ধারার বিভিন্ন উপ-ধারায় দেখা যায়, মানবপাচারে অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। সরকার চাইলেই এসব ব্যক্তির টাকা ক্রোক করতে পারে। এই আইনে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ বছর সাজার বিধান রয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘মানবপাচারের মামলাগুলো পুলিশ অধিকতর তদন্ত করেছে। এসব মামলায় পুলিশের কোনও গাফিলতি নেই। একসময় কক্সবাজারের উপকূল দিয়ে ভয়াবহ মানবপাচার হয়েছে সাগরপথে। সে সময় বিপুল সংখ্যক মানবপাচারের শিকার নারী-পুরুষ এবং জড়িত অনেক পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। একইভাবে মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় আদালতে যদি কোনও সাক্ষী না থাকে ও ভিকটিম উপস্থিত না থাকে; সেখানে পুলিশের করার কিছু থাকে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক পাচাররোধে পুলিশ কাজ করছে। সব বিষয়ে পুলিশের নজরদারি রয়েছে।’

স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন কোনও কোনও পাচারকারী

একসময় মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকে জেল থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। একসময়ের শীর্ষ মানবপাচারকারী ও উখিয়া উপজেলার চেপটখালী গ্রামের ফয়েজ আহমদ সিকদার বলেন, ‘আমি মানবপাচারের বিভিন্ন মামলার আসামি ছিলাম। এখন সবক’টিতে জামিনে রয়েছি। এখন আমি গ্রামে মুদি দোকান দিয়ে জীবনযাপন করছি।’

মনখালী গ্রামের মোহাম্মদ হোছন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মানবপাচারের মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় জামিনে রয়েছি। কোনোভাবেই আমি মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ষড়যন্ত্র করে আমাকে মানবপাচার আইনে আসামি করা হয়েছে। এ কারণে আমার মামলাগুলোর কোনও সাক্ষী নেই। কোনও ভিকটিমও আমার বিরুদ্ধে কথা বলেনি।’

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের পর থেকে মানবপাচারের প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পরে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালীসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচারের ধুম পড়ে। এতে কয়েক লাখ বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের নাগরিক পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাব মতে, ১৬ লাখ বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের নাগরিককে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে চক্র। পরবর্তী সময়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। তখন সাগরপথে মানবপাচার বন্ধে ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। এরপর থেকে এলাকার চিহ্নিত মানবপাচারকারীরা আত্মগোপনে চলে যায়। কিন্তু, সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র।