বাঙালি মুসলিমরা কেন দলে দলে ব্যাঙ্গালোর ছাড়ছেন?

বাংলা ট্রিবিউন ◑ হাই-টেক সিটি’ বলে পরিচিত কর্নাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালোর সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে পরিকল্পিত ও অত্যাধুনিক মেট্রোপলিস। কিন্তু আধুনিকতার আড়ালে এই শহরের একটা গভীর গোপন ‘আন্ডারবেলি’ও আছে – আর সেখানে মানবেতর পরিবেশে আক্ষরিক অর্থেই এই শহরের জঞ্জাল ঘেঁটে কায়ক্লেশে জীবন যাপন করেন হাজার হাজার দরিদ্র বাঙালি মুসলিম।

কিন্তু দু’তিন মাস হলো,এই বাঙালি মুসলিমরা ব্যাঙ্গালোরের পাট গুটিয়ে দলে দলে নিজেদের মুলুকে ফিরে যেতে শুরু করেছেন–শহরের উপকণ্ঠে তাদের ঘিঞ্জি বস্তিগুলো খালি হতে শুরু করেছে। যে গারবেজ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে পুরুষরা ভাত জোটাতেন,রাতারাতি সেই আয়ের রাস্তা তাদের বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর যে গরিব বাঙালি নারীরা শহরের বিভিন্ন হাইরাইজ সোসাইটি বা বহুতল আবাসনে রান্নাবান্না বা পরিচারিকার কাজ করতেন, তারাও চাকরি খোয়াচ্ছেন।

এই সবের পেছনেই আছে কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালোর পুলিশ আর কর্নাটক সরকারের কড়া অভিযান – যার জেরে এই অসহায় মানুষগুলো দলে দলে শহর ছাড়ছেন। অনেককেই জেলে ভরা হয়েছে,অনেকে তার আগেই ভয়ে ঘরবাড়ি ফেলে পালাচ্ছেন।

থুবারাহাল্লিতে ‘কালি খাট্টা’ বস্তি

অবৈধ বিদেশিদের চিহ্নিত করতে আসামের ধাঁচে কর্নাটকেও এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) তৈরির কাজ অচিরেই শুরু হবে বলে কর্নাটকের বিজেপি সরকার আগেই ঘোষণা করেছে,তার আগেই ব্যাঙ্গালোর জুড়ে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের খুব কাছে অবৈধ বিদেশিদের আটক রাখতে একটি ডিটেনশন সেন্টার তৈরির কাজও শেষ,এখন যে কোনও দিন উদ্বোধনের অপেক্ষা!

গত সপ্তাহে ব্যাঙ্গালোর সফরে গিয়ে পূর্ব ব্যাঙ্গালোরের থুবারাহাল্লি বস্তি এলাকায় দেখা গেছে, গ্রামটিকে চিরে দিয়ে গেছে টেক করিডর। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশেই ত্রিপল আর টিনে ঘেরা সার সার ঘর, যেখানে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে থাকেন হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম। রাস্তার একপাশের বস্তিটাকে বলা হয় ‘কালি খাট্টা’, আর অন্য দিকটার নাম ‘লাল মাটি’।

চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি পরিবার
চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি পরিবার
এই দুরকম নামের রহস্যভেদ করতে গিয়ে জানা গেলো, ‘লাল মাটি’তে যারা থাকেন তারা কাজ করেন মূলত শহরের আবাসন শিল্পে। সেখানে জামিলুর বলে এক যুবক জানালেন, ‘আমরা রাজমিস্ত্রি, দিনমজুর বা জোগাড়ের কাজ করি – আর আমরা সবাই ভারতের বৈধ নাগরিক, বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের মালদা-মুর্শিদাবাদ-নদীয়া জেলার লোক।’

আর অন্যদিকে ‘কালি খাট্টা’-র বাসিন্দারা প্রায় সবাই জঞ্জালের স্তূপ ঘেঁটে নানা ধরনের ময়লা ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজ করেন–আর এরাই না কি সবাই তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশি।

কালি খাট্টা বস্তি খালি করে অনেকেই পালাচ্ছেন

এই দাবির সত্যতা যাচাই করার কোনও উপায় নেই,যে গুটিকয় বাঙালির সঙ্গে কালি খাট্টা-তে বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধির দেখা হয়েছে তারা ভয়েই মুখ খুলতে চাইলেন না। তবে এটা দেখা গেল,সেই বস্তিতে একের পর এক ঘর খালি করে বাসিন্দারা উধাও হয়ে গেছেন–স্থানীয় গরিব কন্নড়রা সেই সব ঘরের দখল নিতেও শুরু করেছেন।

আর শুধু থুবারাহাল্লিতেই নয়–একই ছবি ব্যাঙ্গালোরের শহরতলির সারজাপুর, বেলান্ডার বা হোশুরের বাঙালি বস্তিগুলোতেও। সেখানেও হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম (বা কথিত বাংলাদেশি) গত দুমাসের মধ্যে যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছেন।

অথচ ব্যাঙ্গালোরের ওয়েস্ট (বর্জ্য) ম্যানেজমেন্ট বা গার্বেজ সেগ্রিগেশন – অর্থাৎ ময়লা থেকে মেটাল,প্লাস্টিক, কাগজ, মাথার চুল, গদি-তোষক ইত্যাদি আলাদা করার যে শিল্প – সেটা পুরোটাই নির্ভর করত এই কথিত ‘বাংলাদেশি’ শ্রমিকদের ওপর।

শহরের বহুতল আবাসনে কাজ করতেন গরিব বাঙালি মুসলমানরা
শহরের বহুতল আবাসনে কাজ করতেন গরিব বাঙালি মুসলমানরা
‘পুরসভার ঠিকাদাররাই তাদের কাজে লাগাতেন, সময়ে মাইনে না-দিয়েও তাদের পার পাওয়া যেত কারণ ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করায় তারা বেশি চেঁচামেচি করারও সাহস পেত না’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন ব্যাঙ্গালোরের সাবেক পুর কাউন্সিলর কে ভেঙ্কটাপ্পা।

ব্যাঙ্গালোরের কাছে ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টার চালু হওয়ার অপেক্ষায়

সম্প্রতি কর্নাটকে এনআরসি-জিগির শুরু হওয়ারও বেশ আগে থেকেই কথিত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ছুটকো ছুটকা অভিযান অবশ্য চলছিলই। মহাদেবপুরা অঞ্চলের এমএলএ ও কট্টর বিজেপি নেতা অরবিন্দ লিম্বাভালি তো অনেক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে গিয়ে কথিত বাংলাদেশিদের বস্তি ভেঙে দেওয়াসহ উচ্ছেদ অভিযানে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অরবিন্দ লিম্বাভালি এই প্রতিবেদককে বলছিলেন,‘এনআরসি-রও অনেক আগে থেকে আমি বাংলাদেশিদের বিপদ সম্পর্কে ব্যাঙ্গালোরকে সতর্ক করে আসছি। এরা শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদের রুটিরুজিতেই ভাগ বসাচ্ছে না, টাকার লোভ দিয়ে তাদের জঙ্গি কার্যকলাপেও টেনে আনা খুব সহজ। ফলে দেশের নিরাপত্তার জন্যও এরা খুব বড় হুমকি।’

বস্তুত দক্ষিণ ব্যাঙ্গালোরের তরুণ বিজেপি এমপি ও কেন্দ্রীয় স্তরেও দলের ‘উদীয়মান তারকা’ তেজস্বী সুরিয়া পর্যন্ত সম্প্রতি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেছেন তার শহরের ‘অবৈধ বাংলাদেশিরা’ নাকি বিভিন্ন ‘টেরর মডিউলে’ জড়িয়ে পড়েছে।

বিজেপি নেতা অরবিন্দ লিম্বাভালি

এদিকে ব্যাঙ্গালোরের বিভিন্ন বহুতল আবাসনে যে গরিব বাঙালি মুসলিম নারীরা পরিচারিকার কাজ করে দিন গুজরান করতেন তাদেরও বিনা নোটিশে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা শুরু হয়েছে।

শহরের বিভিন্ন রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি তাদের সদস্যদের সোজাসুজি নোটিশ দিয়ে হুকুম দিয়েছে–ঘরের কাজে কোনও বাঙালি মুসলিমকে লাগানো চলবে না।

বিজেপি নেতা অরবিন্দ লিম্বাভালি
বিজেপি নেতা অরবিন্দ লিম্বাভালি
ব্যাঙ্গালোরের অভিজাত সমধুরা সোহম সোসাইটিতে থাকেন কলকাতার মেয়ে অর্পিতা বসু। তিনি ও তার স্বামী দুজনেই মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।বাড়িতে তাদের ছেলেমেয়ের দেখাশুনো,রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজ সবই এতদিন করতেন দুজন বাঙালি মুসলিম নারী। কিন্তু সোসাইটির হুকুমে রাতারাতি তাদেরও কাজ ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে।

অর্পিতা এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে বাংলাদেশি কি ভারতীয় সে সব দেখার কোনও দরকার নেই–বাঙালি মুসলিম হলেই ছাঁটাই করতে হবে। যেহেতু বহুতল আবাসনে সবার সঙ্গে মিলে বসবাস,আমরাও আর কথা বাড়াইনি–ওদের দু’মাসের মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়েছি।’

শহরের এই অসংখ্য বহুতল আবাসনেই কাজ করতেন গরিব বাঙালি মুসলিমরা

এই নিরুপায় মানুষগুলোর ব্যাঙ্গালোরের পাট গোটানো ছাড়া কোনও উপায়ই থাকছে না। এরই মধ্যে দিওয়ালির মাত্র দুদিন আগে ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ শহরের বিভিন্ন বস্তিতে হানা দিয়ে জনাষাটেক নারী-পুরুষ-শিশুকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আতঙ্ক আরও ছড়িয়েছে।

যে কোনওদিন বস্তিতে পুলিশি রেইড হবে–এই ভয়ে অনেকেই বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে কলকাতার ট্রেন ধরছেন। পড়ে আছেন তারাই,যাদের ট্রেনের টিকিট জোগাড় করার পয়সাটুকুও নেই।

শহরের একটি এনজিও ‘মুভমেন্ট ফর জাস্টিস’ বাঙালি মুসলিমদের স্বার্থে অনেকদিন ধরেই লড়ছে,তাদের আইনি সহায়তাও দিয়ে আসছে। ওই সংস্থার কর্ণধার আর কলিমুল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘‘পরিস্থিতি আসলেই খুব সঙ্গীন। আমরা দিব্বি বুঝতে পারছি ‘বাংলাদেশি’ বলাটা একটা অজুহাত–বিজেপি সরকার আসলে টার্গেট করতে চাইছে মুসলিমদের।’’

‘‘কিন্তু আমাদের সমস্যা হল এই তথাকথিত বাংলাদেশিদের হয়ে কিছু বলতে গেলেই আমাদের দেশদ্রোহী বলে গালাগালি করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে আমরা নাকি টেররিস্টদের প্রতি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছি। ফলে আমাদেরও হাত-পা একরকম বাঁধা বললেই চলে”, নিতান্ত অসহায় ভঙ্গিতে বলেন কলিমুল্লা।

থুবারাহাল্লির লাল মাটি বস্তিতে রাতে ক্যারম খেলছেন বাঙালি বাসিন্দারা

এদিকে প্রায় মাসখানেক নিজেদের জিম্মায় রাখার পর দিওয়ালির সময় আটক ৫৯ জন কথিত বাংলাদেশিকে নিয়ে কর্নাটক পুলিশ অবশেষে বিশেষ ট্রেনে করে কলকাতা পাড়ি দেয়।

গত ২৩ নভেম্বর হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছনোর পর পুলিশ অবশ্য তাদের সরাসরি বিএসএফের হাতে তুলে দিতে পারেনি–মানবাধিকার কর্মীদের হস্তক্ষেপে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি অতিথিশালায় তাদের সাময়িক আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু সেই স্বস্তি ছিল মাত্র তিন-চারদিনের। তারপরই কথিত বাংলাদেশিদের ওই দলটি রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে, ভারতের বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করছে তাদের না কি সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে গোপনে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

আর যথারীতি এই গোটা ঘটনার অভিঘাত পৌঁছেছে সুদূর ব্যাঙ্গালোরেও, ধীরে ধীরে বাঙালি মুসলিম-শূন্য হচ্ছে ভারতের এই কসমোপলিটন শহর।